হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও আগুন, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৪
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে আবারও হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ছবি : বাংলাদেশের খবর
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর একদল হামলাকারী দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয়। এতে দুটি অফিসেই ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।
শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার কারওয়ানবাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর চারতলা ভবনটি পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গা থেকে তখনও ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল উপস্থিত ছিল।
প্রসঙ্গত, ভবনটিতে প্রথম আলোর কয়েকটি বিভাগের কার্যালয় ছিল।
হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে ডেইলি স্টারের অফিসের নিচতলা ও দোতলা পুড়ে গেছে। অফিসের ভেতরে ভাঙচুর করে ফেলে রাখা জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। শুক্রবার সকালে ডেইলি স্টারের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়।
এর আগে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতভর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে কারওয়ানবাজারে অবস্থিত দেশের দুটি শীর্ষ গণমাধ্যমের অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় সেখানে অবস্থানরত সংবাদকর্মীরা আটকা পড়েন।
পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ক্রেনের সাহায্যে তাদের উদ্ধার করেন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। হামলাকারীদের সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের ভেতরে লুটতরাজ করতেও দেখা গেছে।
এ সময় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর ঘটনাস্থলে গেলে তাকেও হেনস্তা করা হয়।
পরবর্তীতে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে শুক্রবার সকালে প্রথম আলোর সামনে র্যাবের একটি দল ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও কোনো সেনা সদস্যকে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে পুলিশের ধানমন্ডি ও তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলে জানান ডিউটি অফিসার।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ জানান, বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় তাদের অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থাসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশের কাজ স্থগিত রয়েছে। তবে পরিস্থিতি সামলে দ্রুততম সময়ে কাজ শুরুর চেষ্টা চলছে।
প্রথমবারের মতো হামলার কারণে প্রথম আলোর প্রকাশনা বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
‘পুরো ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত। সাংবাদিকতার জন্য এটি একটি বড় আঘাত,’ বলেন সাজ্জাদ শরিফ।
ডেইলি স্টারের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হামলাকারীরা ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় ভাঙচুর চালিয়েছে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে।
ডেইলি স্টারে কর্মরত একজন জানান, হামলাকারীরা তার ক্যামেরা, ডিভাইস ও হার্ডড্রাইভ লুট করে নিয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, তার সারা জীবনের কাজ ও স্মৃতি এসব ডিভাইসেই সংরক্ষিত ছিল।
গত রাতের ভয় ও আতঙ্ক কাটিয়ে এখনো স্বাভাবিকভাবে কথা বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলেও জানান কয়েকজন কর্মী।
এছাড়াও রাত ১টার দিকে ধানমন্ডিতে অবস্থিত দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়।
হামলার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে ছায়ানটের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক ঘোষণায় জানানো হয়, ভবনটিতে পরিচালিত ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।
এদিকে, আগে দুইবার গুঁড়িয়ে দেওয়া ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আবারও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারে কয়েকজনকে ইট দিয়ে বাড়িটির অবশিষ্ট দেয়াল ভাঙতে দেখা যায়।
শুধু রাজধানীতেই নয়, হামলার শিকার হয়েছে চট্টগ্রামে অবস্থিত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ও। ইনকিলাব মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর কিছু লোক কার্যালয়ের সামনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে হামলাকারীরা পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করলে রাত ২টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এছাড়াও রাত সোয়া ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের বাসায় আগুন দেওয়া হয়। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
সারারাত এসব ঘটনার পর রাত সাড়ে ৪টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়, ‘ওসমান হাদীকে যারা খুন করেছে, তাদের হাতে দেশকে তুলে দেবেন না।’
বার্তায় আরও বলা হয়, ‘ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করতে চায়। ৩২ আর ৩৬ এক জিনিস নয়— এটা আপনাদের বুঝতে হবে।’
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে তিনি লেখেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুস্কৃতিকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি নিহত হওয়ার ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ।’
তিনি আরও লেখেন, ‘দুস্কৃতিকারি সন্ত্রাসীদের কঠোর হস্তে দমন করার বিকল্প নেই।’
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সর্বোচ্চ ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার তাওফিক দান করুন। ধৈর্যই মজলুমের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ধৈর্য ধারণের কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশটি আমাদের সবার অস্তিত্বের অংশ। আশা করি সবাই সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেবো।’

