Logo

মতামত

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় কমিটি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থ উদ্যোগ, তামাশার উপকরণ ব্যক্তি খাত!

Icon

সাইদ আরমান

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪১

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থ উদ্যোগ, তামাশার উপকরণ ব্যক্তি খাত!

সহায়তার নামে বেসরকারি খাতের গলা চেপে ধরছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্যোক্তার অনিয়ন্ত্রিত কারণে কোন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেসব ব্যবসাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে উল্টো তৈরি করা হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, এমন বড় ঋণ পুনর্গঠনে একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকই এখন বলছে, এতো বেশি আবেদন জমা পড়েছে, তাদের দ্রুত নীতি সহায়তা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে সংকট। আর বেসরকারি খাতকে যেন পরিণত করা হয়েছে তামাশার উপকরণে, ফেলা হচ্ছে নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে।

গত ৩০ জানুয়ারি গঠন করা হয় দেশের ইতিহাসে প্রথম এমন কমিটি। ৫০ কোটি বা তার বেশি অঙ্কের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি তৈরি করেছে বিশেষ নীতি সহায়তার সুপারিশ আয়োজনের জন্য, যাতে প্রকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বড় ঋণগ্রহীতারা ঋণ পুনর্গঠন করে অর্থনীতিতে ফিরে আসতে পারে।

তবে, তথ্য উপাত্ত বলছে, ভিন্ন কথা। অবশ্য, যখন কমিটি গঠন করা হয়, তখন অনেক অর্থনীতিবিদ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এতে জটিলতা বাড়বে। তারা তখন বলেন, তফশিলি ব্যাংকের গ্রাহকের ঋণ পুনতফশিলিকরণ প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে যাবার পর, এমন কমিটি তারই নতুনরূপ, এতে বেসরকারি খাতের হয়রানি বাড়বে। উল্টো ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দোহাই দিয়ে, উদ্যোক্তাদের নৈতিক সহায়তা থেকে বিরত থাকবো।

অবশ্য, কমিটি গঠনের ৫ মাসের মধ্যে বিশ্লেষকদের সেই পূর্বাভাসই সত্য হচ্ছে। কারণ, কমিটির কাছে আবেদন জমা পড়েছে সাড়ে ১২শ। কিন্তু যাচাই বাছাই শেষ করে এখন পর্যন্ত কোনো আবেদনই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। আর উদ্যোক্তারা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। হাজারের বেশি আবেদন নিষ্পত্তিতে কত বছর লাগবে সেই প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্টদের মুখে। 

কিছু ব্যাংক সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ঋণ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিলেও অন্য ব্যাংকগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। গত সাড়ে চার মাসে বাছাই কমিটি ১৩টি সভা করেছে। অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মো. মেজবাউল হক। আর ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক হিসেবে মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী সদস্য সচিব ছিলেন।

সম্প্রতি এ দুটি পদেই পরিবর্তন এসেছে। অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন মো. সিরাজুল ইসলাম। আর সদস্য সচিব হিসেবে পরিচালক বায়জিদ সরকার দায়িত্ব পেয়েছেন। কমিটির সদস্য রয়েছেন অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দেলোয়ার হোসেন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হক'স বে অটোমোবাইলসের কর্ণধার আবদুল হক।

জানা গেছে, পুরো কমিটি ব্যর্থ হওয়ার কারণও সঠিক ব্যক্তিদের নির্বাচন করা হয়নি। কমিটির প্রধান মো. মেজবাউল হক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে, নানা বদনাম কুড়িছেন। তার বিরুদ্ধে রিজার্ভ কেলেঙ্কারির দায় রয়েছে। কেবল তাই নয়, স্ত্রীর বদৌলতে, পতিত সরকারের আমলে তিনি সুবিধাভোগ করেছেন। কারণ তার স্ত্রী, বিগত সরকারের সময় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে কাজ করতেন। ফলে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অবহেলার প্রমাণ থাকার পরও তিনি ছিলেন বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয়, প্রভাব খাটিয়ে তিনি পদোন্নতির পর ঢাকার বাইরে বদলি বাধ্যতামূলক থাকলেও তা কার্যকর করতে দেননি। সেই বিতর্কিত কর্মকর্তাকে এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া নিয়েও ছিল খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঝানু ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ।

তথ্য উপাত্ত বলছে, মামুন রশীদ, ভালো অর্থনীতি বিশ্লেষক হলেও, বেসরকারি খাতের অবদানকে তিনি স্বীকৃতি দিতে চান না। তার মনোভাব অনেকটা এমন, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা দেশের ক্ষতিই বেশি করেন, তারা কেবল আর্থিক খাত কেলেঙ্কারি করেন। এমন ব্যক্তিকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েও ছিল প্রশ্ন।

সদস্য আব্দুল হক। তার উৎপাদনমুখী খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। সারা জীবন গাড়ি আমদানি ও বিক্রি করে গেছেন। এমন একজন ব্যবসায়ীকে কীভাবে, এতো গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়, তাই উৎপাদনমুখী খাত তথা শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছে অস্পষ্ট।

বিশ্লেষণ বলছেন, কমিটির দক্ষতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, আবার বেসরকারি খাত নিয়ে যারা এতো নেতিবাচক, তাদের দিয়ে গড়া কমিটি সফল হওয়ার কোন কারণ নেই। অন্যদিকে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীও রয়েছে কমিটিতে। জানা গেছে, কমিটি এতো দিনে মাত্র ৫৬টি আবেদন চূড়ান্ত করেছে। তবে, অনেক ব্যাংক আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিছু ব্যাংক গ্রাহকের ঋণ পুনর্গঠন ঝুলিয়ে রেখেছে। আবার অনেক গ্রাহক আবেদন করে, অপেক্ষায় রয়েছেন, কবে তার বিষয় সুরাহা হবে, তিনি কারখানা সচল করতে পারবেন। এখন করণীয় কী? গভর্নর অবশ্য বলছেন, কমিটির সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে, কাজটি এত জটিল, আর আবেদন এত বেশি। আদতে, এই প্রক্রিয়া এর সুরাহা হবে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, ৫ মাসের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, এটি বেসরকারি খাতের জন্য সহায়ক হয়নি। তাই, এখন একটি নীতিমালা করে, এর দায় দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে দিয়ে দেয়া উচিত। দিন যত যাচ্ছে, বন্ধ কারখানার পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত যদি হয়, সেটি দ্রুত হওয়া দরকার। অন্যথায়,, সুযোগ পেলেও সেটি কাজে লাগানো যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ধারণার থেকে বেশি আবেদন জমা পড়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনোরকম গবেষণা, তথ্য উপাত্ত ছাড়াই কি এই কমিটি গঠন করেছে। যদি সেটি হয়, এই কমিটি কোন বাস্তবতার নিরিখে করা হলো। খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচল ও লাভজনক করাতো দূরের কথা, এখন অংশীদার ব্যাংকও দোহাই দিচ্ছেন কমিটির।

বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনীতি চলমান রাখা এবং ব্যাংক খাতকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করা হয়, যা এখন হিতে বিপরীত। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণ যেমন কোভিড-১৯, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিম্ন প্রবৃদ্ধি, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিমালা সহায়তা দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা, নীতিমালা সহায়তার নামে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বেসরকারি খাতের নতুন বিপর্যয় ডেকে আনছেন বলেই এখন মনে করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা আশা করছেন, এই ভুল পথ থেকে সরে আসতে হবে এখনই।

লেখক : বিশেষ প্রতিবেদক, নাগরিক টেলিভিশন

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর