প্রায় ৫৫ বছর আগে ১৯৭০ সনের ভয়াল ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছাসের কথা মনে পড়লে এখনো চমকে উঠেন আজও বেঁচে থাকা এই অঞ্চলের সে সময়ের মানুষগুলো। জলোচ্ছাসের বিভিষিকাময় মুহুর্তগুলো এখনো ভেসে উঠে তাদের চোখের সামনে। সেই দূর্যোগে দুরাবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো অনেকের চোখে পানি চলে আসে।
জলোচ্ছাসে পিতা মাতা হারিয়েছে তাদের আদরের সন্তান, সন্তান হারিয়েছে তাদের বাবা মা, স্বামী হারিয়েছে তার স্ত্রীকে আর স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে। জলোচ্ছাসের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশুদের আশ্রয়ের প্রয়োজনে তখন বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সরকারিভাবে চরফ্যাসন আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্নে তাবু টানিয়ে চরফ্যাসন এতিমখানাটির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম সরকারিভাবে, পরে বিদেশী দাতা সংস্থা কর্তৃক, বর্তমানে বাংলাদেশী বিভিন্ন দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে এতিমখানাটি।
১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছাসের বাস্তব অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে এসময় অস্ট্রেলিয়ান সংসদ সদস্য লেন এস রিড উপকূলীয় দ্বীপ চরফ্যাসনে আসেন। জলোচ্ছাসের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া পিতৃমাতৃহারা এসকল শিশুদের দেখে ব্যাথিত হন তিনি।
তাদের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে তিনি তাদের দায়িত্ব নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার আশার কথা নিয়ে তিনি সরকারের সাথে আলোচনা করেন। প্রায় দেড় বছর সরকারি ভাবে পরিচালিত হওয়ার পর ১৯৭২ সনে ফরদোজ হু হেভ লেস নামক একটি সংস্থার মাধ্যমে লেন রিড চরফ্যাসন এতিম খানা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। আর লেন রিড’র সাথে আসা ফ্রেড হাইড ১৯৮০ সনে এতিমখানার পরিচালকের দায়িত্ব নেন। ১৯৭২ সনে ইউনিসেফ’র অর্থায়নে এতিম খানার পাকা ভবন নির্মিত হয়। ১৯৮৫ সন পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনার পর সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে লেন রিড ব্যথিত মনে ফিরে যান নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়।
অনাথ এসব শিশুদের রেখে গিয়ে লেন রিড বেশি দিন নিজ দেশে থাকতে পারেননি। হিউম্যান রাইটস ফাস্ট দ্যা চাইন্ড নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হয়ে এক বছর পরই ১৯৮৬ সনে তিনি চরফ্যাসনে রেখে যাওয়া অনাথ শিশুদের মাঝে ফিরে আসেন এবং ফের এই সংস্থার মাধ্যমে এতিম খানার কার্যক্রম শুরু করেন। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি ১৯৯২ সন পর্যন্ত এতিমখানাটি পরিচালনা করেন। ফ্রেড হাইড দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সন থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এতিম খানার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এপর্যন্ত প্রায় ১৮শ’ এতিম শিশু এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও দেশের বাহিরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।
বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ৮০জন ছাত্র রয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫জন এখানে থাকা খাওয়া, পোষাক পরিচেছদসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে উপজেলা সদরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখা পড়া করছে। অন্যরা লেখা পড়া করছে জেলার বাহিরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাদের থাকা খাওয়া, পোষাক পরিচ্ছেদ সহ পড়ালেখার যাবতীয় খরচ এতিম খানা বহন করছে। অরফেন ট্রাস্ট নামক ইংল্যান্ডের একটি দাতা সংস্থা স্টাপদের বেতনের কিছু অংশ (যার পরিমান বছরে ৫০ হাজার টাকা) অনুদান হিসেবে প্রদান করছেন।
এছাড়া সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবছর পাওয়া যায় ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানের খামারের মাছ বিক্রি, লিজকৃত জমির আয় এবং মার্কেটের দোকান ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ। যার পরিমান বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে জনবল রয়েছে ১১ জন। ষ্টাফ বেতন বছরে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। বাকী অর্থ ছাত্রদের ষ্টেশনারী, পোষাক পরিচ্ছেদ, খাওয়া খরচসহ যাবতীয় কাজে ব্যয় হয়।
এতিমখানার দায়িত্বপাপ্ত চেয়ারম্যান এইচ এম মাইনুদ্দিন আহমেদ জাহাঙ্গীর জানান, সরকারি এবং দেশী বিদেশী বিভিন্ন দাতাদের কাছ থেকে বছরে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোন রকম চলে। তবে প্রতিষ্ঠানের যে জমি আছে তাতে ভবন নির্মান পূর্বক মার্কেট করে ভাড়া দিতে পারলে আয় আরো বাড়তো, তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি এবং বিদেশী অর্থসহায়তা।
লেখক : সাংবাদিক
বিকেপি/এনএ

