বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি : কেন দ্রুত প্রস্তুতি দরকার?
রাসেল হোসেন
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৫
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
ভূমিকম্প (সাধারণ অর্থে ভূমির কম্পন) ভূতত্ত্ব বা জিওলজির অন্তর্গত। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী, ভূমিকম্প ঘটে প্লেট টেকটোনিকের সংঘর্ষের ফলে। দুটি মহাদেশীয় প্লেটের সীমান্ত অঞ্চলে প্রবল চাপ সৃষ্টি হলে, সেই চাপ যদি হঠাৎ বড়সড় শিলাচ্যুতির মাধ্যমে মুক্তি পায়, তখনই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এছাড়া ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গভীরতায় বড় বিস্ফোরণ ঘটলেও মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশের ১০০ বছরের ভূমিকম্প ইতিহাসে ছোট-বড় অনেক ভূমিকম্প ঘটেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
ভূ-অভ্যন্তরে স্থিত গ্যাস যখন ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে বের হয়, তখন সেই স্থানের চাপ হঠাৎ কমে যায়। পৃথিবীর উপরের তলার চাপ সেই ফাঁকা স্থানে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে, আর তখনই ভূ-পৃষ্ঠে প্রবল কম্পন অনুভূত হয়, যা ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সাধারণত ভূমিকম্প তিনটি কারণে ঘটে—ভূপৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা এবং শিলাচ্যুতি।
ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক সেকেন্ড হয়। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে পারে। ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার হয়, তার নাম রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হলে তা ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা নির্দেশ করে। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে এর শক্তি ১০ থেকে ৩২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। রিখটার স্কেলে মাত্রা অনুযায়ী ভূমিকম্পের শ্রেণি হলো—৫–৫.৯৯: মাঝারি, ৬–৬.৯৯: তীব্র, ৭–৭.৯৯: ভয়াবহ, এবং ৮-এর উপর: অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। ভূগোল অনুযায়ী, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ প্লাবন সমভূমি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর নদীবিধৌত অঞ্চলে এই বিশাল সমভূমি গঠিত হয়েছে। অপরদিকে, দেশের মাত্র ১২ শতাংশই পাহাড়ি উঁচু ভূমি।
দেশের ভূগঠন অনন্য হলেও মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদরা দেশের তলদেশের এই গঠন নিয়ে বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন।
চলতি বছর দেশে কয়েকবার ভূমিকম্প ঘটেছে। সাম্প্রতিক কয়েকদিনে চারবার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে একটি ভূমিকম্পে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। এতে শিশুসহ ১০ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে—পাঁচজন। ঢাকায় চারজন, নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে এবং ফাটল দেখা দেয়।
সর্বশেষ, শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাত ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে। এক সেকেন্ড পর রাত ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয় ভূমিকম্প হয়, যার মাত্রা ৪.৩। উৎপত্তিস্থল প্রথমটির বাড্ডায়, দ্বিতীয়টির নরসিংদীতে।
ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়া আতঙ্কের কারণ। বাংলাদেশে ভূমিকম্প অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু প্রশ্ন হলো— দেশের সমতল ভূগঠন থাকা সত্ত্বেও বারবার ভূমিকম্প কেন হয়? বাংলাদেশের অবস্থান কি এর মূল কারণ? ভবিষ্যতে বড়সড় ভূমিকম্প হতে পারে কি?
বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের আসামে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। কেন্দ্র ঢাকা থেকে ২৫০ কিমি দূরে ছিল। তখন ঢাকায় মাত্র ১০০টি পাকা ভবন ছিল, অধিবাসী সংখ্যা ৯০ হাজার। ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে থাকা বাংলাদেশের ঘনবসতি, পুরনো অবকাঠামো এবং দুর্বল বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ দেশকে বিপদে ফেলে। ঢাকার ৪০ শতাংশ ভবন ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ধসে যেতে পারে।
২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের অনেক স্থাপনা কাঠামোগত মান পূরণে ব্যর্থ। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের এলাকায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবকাঠামোর কারণে অকল্পনীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে, ১৮৬৯–১৯৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প (৭-এর ওপরে) ঘটেছে। এরপর থেকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প স্তিমিত হলেও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন— বিপর্যয়ের আগে নীরবতা থাকতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে রেকর্ড করা ৬০টি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি ৪-এর ওপরে এবং ৩১টি ৩–৪ মাত্রার মধ্যে। এই ঊর্ধ্বগতি, শহর এলাকায় বিস্তার ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো জাতিকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তুলে ধরছে।
ভূমিকম্পের সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস বা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। যা করা যায় তা হলো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল শনাক্ত করা, ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করা এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে প্রাণ ও মালের ক্ষয় কম হয়।
জাপান রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্পেও ভবন ভেঙে না পড়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে ঢাকার মতো অতি ঘনবসতি এলাকায় বহুতল ইমারত তৈরি হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে, কিন্তু বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। ভূমিকম্প সংঘটিত হলে তার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়েছে। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেয়ে ৪১টি, আর ২০২৪ সালে ৫৩টি হয়েছে— এটি আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্পের সূচক হতে পারে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প আসার সময় এসেছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ঢাকার অতি ঘনবসতি, জনঘনত্ব ও অপরিকল্পিত নগরায়ন শহরটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণে ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে।
বাংলাদেশে দুর্যোগ আইন, ‘এসওডি’ বা স্থায়ী আদেশাবলী এবং জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ভূমিকম্প প্রস্তুতি অনেকটাই উপেক্ষিত। সাধারণ মানুষ ভূমিকম্পের প্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতন নয়, যা বিপদের মাত্রা বাড়াচ্ছে।
২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে। আতঙ্কে ৬ জন মারা যান। বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা রানা প্লাজার ধসের উদাহরণ স্মরণ করিয়ে দেয়। উদ্ধারকাজে ১৫ দিন লেগেছিল। ফলে দেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আধুনিকায়ন করা, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুত রাখা জরুরি।
ভূমিকম্পের পর উপকূলীয় অঞ্চলে সুনামির সম্ভাবনা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, হাসপাতাল আধুনিকীকরণ, জনগণকে সচেতন করা এবং সঠিক গাইডলাইন প্রণয়ন অপরিহার্য। গবেষণালব্ধ ফলাফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ভূমিকম্পসহনশীল ভবন তৈরি, সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে। অন্যথায় দুর্যোগ সংঘটিত হলে পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এমএইচএস

