জকসু নির্বাচনে দলীয়, নাকি স্বতন্ত্র : কাদের বেছে নেবেন শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫১
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম এবং দীর্ঘ ৩৮ বছর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) ও হল সংসদ ২০২৫ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মনোনয়নপত্র বিতরণ, দাখিল এবং প্যানেল ঘোষণার পর এখন ক্যাম্পাসে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন শিক্ষার্থীরা কি দলীয় রাজনীতির প্রতিনিধিদের বেছে নেবেন, নাকি স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রার্থীকেই ভোট দেবেন!
এরই মধ্যে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রশক্তি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘরানার সমর্থিত প্যানেল ঘোষণা হয়েছে। একই সাথে মনোনয়ন নিয়েছেন সতন্ত্র প্রাথীরা। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অরাজনৈতিকভাবে কিংবা দলীয় প্রভাব মুক্ত থেকে কারা কাজ করবেন! জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি দলীয় একক আধিপত্যের প্রভাব মুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস। এরই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। এবিষয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী কাজী মারুফ বলেন, জকসুতে এমন প্রার্থী চাই, যে অবহেলিত ক্যাম্পাসকে বদলে দিতে নিবেদিতভাবে কাজ করবে। আবাসন সংকট দূর করা থেকে শুরু করে জবিয়ানদের অধিকার আদায় সবক্ষেত্রেই যারা ভূমিকা রাখবে। শুধু ক্যাম্পাসে নয়, দেশের ভেতর-বাহির থেকেও শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আনতে পারবে। শিক্ষার্থী সংসদ কার্যকর হলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সেবা, অভিযোগ নিষ্পত্তি, একাডেমিক প্রশাসনিক যোগাযোগে স্বচ্ছতা বাড়বে। তাই অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচিত নেতৃত্ব যে-ই হোক, ক্যাম্পাসের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সমাধানে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। দলীয় প্যানেলের অভিজ্ঞতা, সম্পদ ও সংগঠিত প্রচার সুবিধা তাদের এগিয়ে রাখবে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় চাপমুক্ত থেকে ক্যাম্পাসের জন্য শক্ত অবস্থান নিতে পারবেন। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান কবির বলেন, “দলীয় হলে হয়তো প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়, কিন্তু দলীয় প্রভাবের কারণে অনেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। স্বতন্ত্ররা স্বাধীন, কিন্তু তাদের ক্ষমতা কতটা হবে সেটা প্রশ্ন।” দর্শন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী রাতিয়া বলেন, জকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে উৎসব মূখর পরিবেশ বিরাজ করছে। দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীতার প্রশ্নে আমার মনে হয় এবার যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতাই মূল বিবেচ্য হবে। দলীয় প্রার্থীদের সংগঠনের শক্তি থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি আছে; স্বতন্ত্ররা বেশি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক। তাই যিনি বাস্তব সমস্যায় কাজ করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা তাকেই নির্বাচিত করব।
শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের তুলনায় তাদের প্রচার সামর্থ্য কম হওয়ায় অনেকেই ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বলছে তারা দল নয়, ইস্যুভিত্তিক প্রার্থী চান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদিবা নাওমি বলেন, “কোন প্যানেল কোন দলের এটা সবাই জানে। কিন্তু আমরা চাই এমন প্রতিনিধি, যিনি আসলেই শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবেন।”
দর্শন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী হুমায়রাত হক প্রমি বলেন, দলীয় প্রার্থীরা সংগঠনের অভিজ্ঞতা ও শক্তিতে এগিয়ে থাকলেও অনেক সময় দলীয় সিদ্ধান্তে বাঁধা পড়ে। বিপরীতে স্বতন্ত্ররা সরাসরি শিক্ষার্থীদের জন্য কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আস্থা জোগায়। যদিও সংগঠনগত শক্তির অভাবে তাদের পথ কঠিন। শেষ পর্যন্ত আমরা চাই এমন নেতৃত্ব, যে ব্যক্তিস্বার্থ নয় শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে।
আরেক শিক্ষার্থী রিশাদ আহমেদ বলেন, এবারে জকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষেই ভোট যাওয়া উচিত। কারণ দলীয় রাজনীতি যতটা উত্তেজনা ও বিভাজন তৈরি করে, স্বতন্ত্ররা ততটাই শান্ত ও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পরিবেশ বজায় রাখে। কোনো দলের নির্দেশনা না থাকায় তারা সরাসরি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং জবাবদিহিও বেশি থাকে। সংঘর্ষহীন, স্বচ্ছ নেতৃত্ব চাইলে স্বতন্ত্রই সবচেয়ে যুক্তিসংগত ও নিরাপদ বিকল্প। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউ কেউ রয়েছেন আলোচনার শীর্ষে। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কণ্ঠস্বর হওয়ার প্রত্যয়ে নির্বাচন করছেন তারা। তাদের দাবি, সতন্ত্র প্রার্থীরা সবসময় শিক্ষার্থীদেরকেই প্রাধান্য দিবেন। কিন্তু দলীয় প্যানেলে অনেক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে। যেখানে, প্যানেল ঘোষণার সময় দলীয় মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়, সেখানে নির্বাচিত হয়েও দলীয় মতামতকে সমর্থন করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার সুযোগ নেই বলে মনে করেন সতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা বিভিন্ন বিভাগীয় ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা একাডেমিক খ্যাতির জন্য ক্যাম্পাসে পরিচিত।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভিপি প্রার্থী ইয়াসিন পিয়াস বলেন,“জকসু এমন জায়গা হওয়া উচিত যেখানে দল-মত ছাড়াই শিক্ষার্থীর মতামত প্রাধান্য পায়। আমি সেই প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।”
সতন্ত্র ভিপি প্রার্থী চন্দন কুমার দাস বলেন,“আমরা শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করতে চাই। যদি তাদের সঙ্গে না মিশি, তাহলে প্রতিনিধিত্ব করা যায় না। আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই, তাই শিক্ষার্থীর সমস্যা ভালো বুঝি।”
এদিকে প্যানেল ভিত্তিক নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের দাবি, রাজনৈতিক পরিচয় নয়, তাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও ক্যাম্পাস-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করা।
‘অদম্য জবিয়ান ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে আমরা তাদের সমস্যা চিহ্নিত করেছি। কোন কাজগুলো আগে করব, কোনগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব এগুলো নিয়ে আমরা ইশতেহার ঘোষণা করব। এখনো ইশতেহার রেডি হয়নি, রেডি হলে জানাবো ইনশাআল্লাহ।”
‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী খাদিজাতুল কুবরা বলেন, “রাজনৈতিক দলের কাজ করলে দলের পরিচয় বহন করব। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজে গেলে জকসুর জিএস হিসেবেই দায়িত্ব পালন করব।”
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ জবি প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবর
বিকেপি/জেএন/এমএইচএস


