Logo

মতামত

‘জি হুজুরের কাছে’ যোগ্যতা হার মেনে যায়

Icon

রিয়াজুল হক

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৫

‘জি হুজুরের কাছে’ যোগ্যতা হার মেনে যায়

যোগ্যতার বদলে আনুগত্যের মূল্যায়ন যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, জাতিও হেরে যায়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, অধিকাংশ ঊর্ধ্বতনরা— মেধাবীদের দূরে সরিয়ে রেখে—‘জি হুজুর’ তোষামোদকারী, অদক্ষদের পাশে রাখে। এটাই আমাদের কর্মসংস্কৃতির এক নির্মম বাস্তবতা। মেধা, সৃজনশীলতা কিংবা সততার চেয়ে এখন অনেক জায়গায় প্রভাব, চাটুকারিতা, ‘আমার কথায় হ্যাঁ বলবে’ মনোভাবটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর ফল কি ভালো হয়? একেবারেই না। অফিসে দক্ষরা নিরুৎসাহিত হয়, তোষামোদকারীরা পুরস্কৃত হয়, আর প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থান ক্রমেই তলানিতে নেমে যায়।

অধিকাংশ অফিসে চোখ রাখলে আমরা প্রায়ই একই চিত্র দেখি। যিনি প্রশ্ন করেন, উন্নতির প্রস্তাব দেন, সঠিক পথে কাজ করতে চান— তাকে কাজের ভালো সুযোগ দেওয়া হয় না, দূরে রাখা হয়। অন্যদিকে, যিনি ‘জি স্যার, ঠিক বলেছেন স্যার’ বলে মাথা নাড়েন, তিনিই ঊর্ধ্বতনের অনেক প্রিয়। এমন কর্মসংস্কৃতিতে বুদ্ধিমান, সৎ ও উদ্যমী কর্মীরা ধীরে ধীরে প্রান্তে চলে যান।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জন্ম নেয় ‘জি হুজুর’ সংস্কৃতি? এর মূলে আছে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ ও অনিরাপত্তা। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, বুদ্ধিমান অধস্তন মানেই হুমকি। তারা ভয় পান, মেধাবী কেউ সামনে গেলে নিজের অবস্থান টলে যাবে। তাই তারা দক্ষদের দূরে রাখেন, আর পাশে রাখেন সেইসব মানুষকে, যারা তাদের ভুলও সঠিক প্রমাণ করতে পারে।

যে কর্মী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সময়মতো কাজ শেষ করেন, নতুন কিছু চিন্তা করেন, সে বরাবরই ‘অতি বোঝে’ হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে, যিনি দিনভর বসের সামনে ঘুরে বেড়ান, অফিসের ছোটখাটো বিষয়ে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ‘স্যার স্যার’ করে হেঁটে বেড়ান— তিনিই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতি, বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। 

এই সংস্কৃতি শুধু কর্মী নয়, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকেও পঙ্গু করে। কারণ, ‘জি হুজুর’ বলা লোকেরা কখনো ভুল ধরতে শেখে না; তারা কেবল মুখ রক্ষা করে চলে। এর ফলে, যোগ্যরা হারিয়ে যান, আর তোষামদকারীরা নীতি নির্ধারণের টেবিলে বসে যান।

এই সংস্কৃতি শুধু অফিস নয়, জাতির ভবিষ্যতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যখন একটি প্রজন্ম দেখে, ‘মেধা নয়, সম্পর্কই সাফল্যের চাবি’, তখন তারা আর পরিশ্রমে আগ্রহী থাকে না। দক্ষদের মধ্যে হতাশা, অফিসে নিষ্ক্রিয়তা, সমাজে দুর্নীতি, সবই এই মনোভাবের উপসর্গ।

তাহলে এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

প্রথমত, ঊর্ধ্বতনদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। যোগ্য ও সৎ কর্মীকে ভয় নয়, সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। কে কীভাবে কাজ করছে, তার পরিমাপ স্পষ্ট হতে হবে।

এবং তৃতীয়ত, তোষামোদ নয়, ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন করতে হবে।

যে ঊর্ধ্বতন সাহসী পরামর্শকে মূল্যায়ন করেন এবং নিজের চেয়ে দক্ষ লোককে সঙ্গে রাখেন, তার প্রতিষ্ঠানই প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হয়। ‘জি হুজুর’ সংস্কৃতি একদিনে জন্ম নেয়নি, একদিনে যাবেও না। তবে পরিবর্তনের শুরু হতে পারে যদি মেধা ও সততার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাহলেই সত্যিকার উন্নয়ন সম্ভব, যেখানে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য নয়, কাজের জন্য সবাই কাজ করবে।

লেখক : রিয়াজুল হক, অতিরিক্ত পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর