Logo

রাজনীতি

রাজনীতিকরা নিরাপত্তাহীন

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:২০

রাজনীতিকরা নিরাপত্তাহীন

গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা-ভাঙচুর | ছবি : সংগৃহীত

এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও চারজনের প্রাণহানির পর তোলপাড় চলছে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে। সংঘটিত ভয়াবহ হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনার একদিন পর বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা ও সমন্বয় নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। 

সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা হুমকির তথ্য থাকার পরও কেন এই নারকীয় পরিস্থিতি এড়ানো গেল না, সেই ব্যর্থতার দায় কার—এ নিয়েই চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। অন্যদিকে, এনসিপি নেতারা এ ঘটনার বিচার না হলে গোপালগঞ্জে ফের লংমার্চের মতো কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন।

সরকারের পদক্ষেপ
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ে যখন দেশজুড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, তখন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি কার্যত গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে বলেন, গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি যে এত খারাপ হবে, সে তথ্য ছিল না। এই একটি বাক্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রস্তুতির ঘাটতি কতটা মারাত্মক ছিল। তবে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় যারা অন্যায় করেছে, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে, কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সহিংসতা ও প্রাণহানির এই ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নসিমুল গনিকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে প্রশাসন এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিবও থাকবেন। কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং যেকোনো অবৈধ কার্যকলাপ ও সহিংসতায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

যেভাবে ব্যর্থ হলো নিরাপত্তা পরিকল্পনা
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে যে তথ্য সামনে এসেছে, তা রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতো। জানা গেছে, এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে নিরাপত্তা হুমকির সুনির্দিষ্ট তথ্য অন্তত ১০ দিন আগেই পুলিশের হাতে ছিল। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে হামলার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি ঘটনার আগের দিন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইউরোপে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টিও গোয়েন্দা তথ্যে উঠে আসে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ঘটনার আগের দিন (মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই) পুলিশ সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, এমনকি গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান এবং ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিকও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে গোপালগঞ্জের নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেলা পুলিশের নিয়মিত ফোর্সের পাশাপাশি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১০০ সদস্য এবং রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের (আরআরএফ) ১৫০ সদস্য-অর্থাৎ অতিরিক্ত ২৫০ সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মাত্র ৩০-৪০ জন হামলাকারী যখন এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে প্রথম হামলা চালায়, তখন সেখানে দ্বিগুণ সংখ্যক অর্থাৎ প্রায় ৬০ জন পুলিশ সদস্য উপস্থিত থেকেও কেন তাদের প্রতিহত করতে পারল না? সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যে হামলার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে কোটালীপাড়ার প্রবেশমুখ, জেলা পুলিশ লাইনসের আগে ও পরের মোড় এবং মাঝিগাতী ঢালনিয়া ব্রিজসহ একাধিক জায়গার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নারী ও শিশু দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করিয়ে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও গোয়েন্দা রিপোর্টে ছিল। এত বিস্তারিত তথ্য থাকার পরও কেন মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, তা নিয়ে খোদ পুলিশ বিভাগেও তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। আইজিপি বাহারুল আলম এই ব্যর্থতার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

আইএসপিআর, আসক এবং প্রচারণার যুদ্ধ
সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, উচ্ছৃঙ্খল জনতা যখন সরকারি স্থাপনা ও যানবাহনে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করছিল, তখন সেনাবাহিনী তাদের মাইকে বারবার নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু হামলাকারীরা সেনাবাহিনীর ওপর বিপুলসংখ্যক ককটেল ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে সেনাবাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়’।

তবে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার একটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং জনগণের জীবনরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আসক পুলিশের মহাপরিদর্শকের 'প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি' বক্তব্যের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ভিডিওর অসামঞ্জস্য তুলে ধরে প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে কারা এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করল? সংস্থাটির মতে, এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না দিলে প্রশাসনের প্রতি জনগণের অনাস্থা আরও বাড়বে।

এদিকে, মাঠের সহিংসতার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এক ব্যাপক ‘প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ফ্যাক্ট চেক বিভাগ জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের একটি সংঘবদ্ধ চক্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুরনো এবং সম্পর্কহীন ছবি ব্যবহার করে সহিংসতার দায়ভার এনসিপি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস এম জাকির হোসেন এবং সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনসহ অনেকেই ২০২২ সালের নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সমাবেশের ছবি, ২০২৩ সালের ভিন্ন ঘটনার ছবি, এমনকি একটি সম্পাদিত শিশুর ছবি পোস্ট করে দাবি করেন যে, এগুলো গোপালগঞ্জের সহিংসতার চিত্র। এই পরিকল্পিত মিথ্যাচার জনমতকে বিভ্রান্ত করার একটি অপচেষ্টা বলে প্রেস উইং উল্লেখ করেছে।

এনসিপির হুঙ্কার ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি
এই নারকীয় হামলার শিকার হয়েও দমে যায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি। ঘটনার পরদিন ফরিদপুরে আয়োজিত এক সমাবেশে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গোপালগঞ্জে আমাদের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। গোপালগঞ্জের ফ্যাসিস্টরা তাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেছে।’ তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষকে যেন হেনস্তা না করা হয়, কিন্তু হামলাকারী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

নাহিদ ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, অবিলম্বে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করলে গোপালগঞ্জে শিগগিরই লংমার্চ করব। আমরা ফিরে আসার জন্য লংমার্চ করব না। গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষকে সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদমুক্ত করে ফিরব।

গোপালগঞ্জের ঘটনাটি নিছকই একটি স্থানীয় সংঘাত নয়। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। একদিকে যেমন দোষীদের চিহ্নিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তেমনই নিশ্চিত করতে হবে যেন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী নতুন করে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয়। গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায় নির্ধারণ এবং মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়হীনতার কারণ খুঁজে বের করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। গোপালগঞ্জের কারফিউ ওঠা শহর এখন শান্ত থাকলেও এর বাতাসে মিশে আছে চাপা উত্তেজনা, অবিশ্বাস আর বিচারের প্রতীক্ষা।

  • বিকেপি/এটিআর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব জাতীয় নাগরিক পার্টি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর