দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে রাজধানী ঢাকা এবং সারা দেশে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রস্তুতি ও জনউদ্দীপনা দেখা দিয়েছে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকামুখী জনস্রোত, বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টার কড়াকড়ি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গুলশান ও তিনশ ফিট এলাকায় বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন এবং কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের উপস্থিতির প্রত্যাশার পাশাপাশি সরকারও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত যাত্রাপথে নজিরবিহীন প্রস্তুতি, কনস্যুলার ও প্রশাসনিক সমন্বয়, সারা দেশ থেকে ট্রেন রিজার্ভসহ দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক আয়োজন- সব মিলিয়ে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি ব্যক্তিগত ফেরা নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু প্রতীক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এদিকে তারেক রহমান বিমানবন্দর থেকে সরাসরি যাবেন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে। এরপর হাসপাতাল থেকে যাবেন রাজধানীর তিনশ ফিটে সংবর্ধনাস্থলে। সেখান থেকে তার গুলশানের বাসভবনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে তারেক রহমানকে দেখতে ও তার সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে সারা দেশ থেকে রাজধানীতে আসছে মানুষ।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দেশে ফেরার সার্বিক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ট্রাভেল পাস হাতে পেয়েছেন তারেক রহমান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিজি ২০২০ ফ্লাইটে টিকিট বুকিং করেছেন তারেক রহমান। ফ্লাইটটি ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে।
সব ঠিক থাকলে বোয়িং ৭৮৭-৯ মডেলের উড়োজাহাজটি ২৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছবে। এই ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাসে তারেক রহমানের পাশাপাশি আরও পাঁচ সফরসঙ্গীর টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও কন্যা জাইমা জারনাজ রহমান। এ ছাড়া তারেক রহমানের মিডিয়া টিমের প্রধান আবু আবদুল্লাহ সালেহ, পারসনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট আব্দুর রহমান সানি ও তাবাসসুম ফারহানা নামে আরেকজন।
বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সসহ একাধিক টিম কাজ করবে। এ ছাড়া দলের বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের সমন্বয়েও একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। এ নিয়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও বৈঠক করছে। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত তারেক রহমানকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে, তারেক রহমান দেশে এলে তার নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো ঝুঁকির তথ্য নেই। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার নিরাপত্তায় কোথাও যেন কোনো ফাঁক না থাকে, এ বিষয়টি জোরালোভাবে তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দেশে ফেরার পর তারেক রহমান যাতায়াতের সময় পাবেন পুলিশি পাহারাসহ বিশেষ নিরাপত্তা। এ ছাড়া তার বাসভবন ও অফিসেও থাকবে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে তার ধারে কাছে ভিড়তে দেবে না পুলিশ। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন।
দেশে ফেরার পর যেকোনো সময় বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে যাওয়ার কথা রয়েছে তারেক রহমানের। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, প্রত্যাবর্তনের পরদিন শুক্রবার তিনি সেখানে যেতে পারেন।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। পরে শনিবার ভোটার হওয়ার জন্য সব কার্যক্রম শুরু করবেন।’
অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের উপস্থিতি হবে: রিজভী
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে ঢাকায় অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের উপস্থিতি থাকবে বলে আশা করছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। মঙ্গলবার রাজধানীর তিনশ ফিটে তারেক রহমানকে সংবর্ধনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকা মঞ্চ দেখতে এসে এ প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী শক্তির একজন প্রতীক। তার নিরাপত্তা প্রথমত সরকারের দেখার কথা, তারপর দল। দল সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেভাবেই প্রস্তুতিও নিচ্ছে। আশা করি সরকারও সেটা নিচ্ছে। যেটার কিছু উদাহরণ আমরা এখানে পাচ্ছি, দৃষ্টান্ত আমরা পাচ্ছি।
তিনি বলেন, আগামী পরশুদিনের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শান্তিপূর্ণ হবে। অসংখ্য জনতার শুভেচ্ছায় সিক্ত হবেন তিনি। সেই জনসমাগমকে তিনি শুভেচ্ছা জানাবেন। অনেক দিন পর তিনি ফিরে আসছেন, তাদের অভিবাদন জানাবেন।
শাহজালালে ২৪ ঘণ্টা যাত্রী ছাড়া অন্যদের প্রবেশ বন্ধ: বিশেষ অপারেশনাল ও নিরাপত্তাজনিত কারণে আজ বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী ছাড়া সহযাত্রী ও ভিজিটরের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগিব সামাদ বিষয়টি জানান।
বরণে চলছে মহাযজ্ঞ:
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক কৌতূহল ও আলোচনা। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের অফিস ও নেতাকর্মী, এমনকি ঘরোয়া পরিবেশেও আলোচনায় তারেক রহমান। দলের শীর্ষ নেতাকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী। নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা।
নগরীর প্রধান সড়ক, অলি-গলি ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ঝুলছে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও বিলবোর্ড। এতে বড় অক্ষরে উৎকীর্ণ- ‘লিডার আসছে’, ‘হে বিজয়ী বীর, তোমাকে স্বাগত’ ইত্যাদি স্লোগান। রাজধানীর পল্টন, মৎস্য ভবন মোড়, কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, কারওয়ানবাজার, মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে লাগানো এসব ব্যানার-বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে তারেক রহমানের ছবি।
প্রস্তুত গুলশান ১৯৬: ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আগমনকে কেন্দ্র করে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে বিএনপির গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়। প্রস্তুত গুলশান-২-এর এভিনিউ রোডের ১৯৬ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতে উঠবেন তিনি। গুলশান কার্যালয় এবং তার থাকার বাড়ির চারপাশে কাঁটাতার দিয়ে করা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে প্রজেক্টর। যার মাধ্যমে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য লাইভ দেখানো হবে।
নেতাকর্মীদের আসার সুবিধার্থে বিএনপির পক্ষ থেকে আজ ২৪ ডিসেম্বর রাতের বিভিন্ন রুটে ট্রেন রিজার্ভ করা হয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ভাড়া পরিশোধ করা হবে। দলের পক্ষ থেকে কক্সবাজার-ঢাকা, সিলেট-ঢাকা, জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা, টাঙ্গাইল-ঢাকা, চাঁপাইনব্বাগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকা, পঞ্চগড়-নীলফামারী-পার্বতীপুর-ঢাকা ও কুড়িগ্রাম-রংপুর-ঢাকা রুটের জন্য একটি করে স্পেশাল ট্রেন বা অতিরিক্ত বগি রিজার্ভ করা হয়েছে।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান তারেক রহমান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান প্রয়োজনে কয়েকবার দেশে আসতে পারলেও তিনি পারেননি। অবশেষে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সব প্রশ্নের অবসান ঘটতে যাচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর।
বিকেপি/এনএ

