বেগম খালেদা জিয়া
জন্ম: ১৯৪৫ মৃত্যু: ২০২৫
জন্মস্থান: অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়ি
স্বামী: জিয়াউর রহমান
সন্তান: জ্যেষ্ঠ পুত্র, তারেক রহমান কনিষ্ঠ পুত্র, আরাফাত রহমান কোকো (২০১৫ সালে প্রয়াত) রাজনৈতিক ১৯৮২ সালে বিএনপির সদস্য জীবন: ১৯৮৩-তে দলের সহ-সভাপতি ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসন
প্রথম দফায়- ১৯৯১ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
দ্বিতীয় দফায়- ১৯৯৬
তৃতীয় দফায়- ২০০১
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চলে গেলেন না ফেরার দেশে । গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল। ৮০ বছর।
গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় এভারকেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়াও বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে জানানো হয়, খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। আজ (গতকাল) সকাল ৬টায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মৃত্যু ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণা দেন । এছাড়াও খালেদা জিয়ার জানাজা উপলক্ষ্যে সরকার আজ একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে বলেও জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শোক: খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস। গতকাল এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতির এই অপূরণীয় ক্ষতির মুহূর্তে আমি মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও অনুসারীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। দেশবাসীকে মরহুমার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দোয়া ও প্রার্থনার আহ্বান জানাচ্ছি।'
প্রধান উপদেষ্টা গতকাল দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং আগামীকাল (আজ) তার নামাজে জানাজার একদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি।' তিনি বলেন ‘আজ পুরো জাতি গভীর শোক ও বেদনায় নিস্তব্ধ। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির শীর্ষ নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই।'
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দক্ষিণ প্লাজায় আজ খালেদা জিয়ার জানাজা পড়াবেন জাতীয় মসজিদের খতিব। জানাজা শেষে সংসদ ভবন এলাকার পাশে অবস্থিত জিয়া উদ্যানে তার স্বামী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল। এদিকে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। তিনি বলেন, ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ ও ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। শোক ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
গতকাল খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফনের সময়সূচি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, বুধবার (আজ) বেলা ২টায় জাতীয় সংসদ ভবন মাঠ ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জানাজা হবে। এরপর আনুমানিক বেলা সাড়ে ৩টায় শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে । জানাজার সময় কোনো ব্যাগ বা ভারী সামগ্রী বহন করা যাবে না। দাফনের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবে হবে বলে সেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার থাকবে না।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র, বিভিন্ন দূতাবাস, শেখ হাসিনা, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ বিভিন্ন দেশের সংগঠন ও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ।
জানাজায় আসছেন পাকিস্তান-ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা ও শ্রদ্ধা জানাতে অংশ নেবে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও মালদ্বীপের প্রতিনিধি । পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি.এন. ধুঙ্গেল এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে দেশটির উচ্চ শিক্ষা, শ্রম ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ড. আলি হায়দার আহমেদ খালেদা জিয়ার শেষ যাত্রায় অংশ নিতে বুধবার (আজ) ঢাকায় আসছেন।
শেষ মুহূর্তে পাশে ছিলেন তারেক রহমান ও স্বজনরা: মৃত্যুর সময় খালেদা জিয়ার শয্যাপাশে ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় হাসপাতালে আরও উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান এবং প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। স্বজনদের মধ্যে ছোট ভাই শামীম এসকান্দার ও তার স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও শেষ সময়ে হাসপাতালে ছিলেন। এছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এবং খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শোক জানিয়েছেন বিএনপিপন্থি বিভিন্ন সংগঠনসহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন ও দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা।
সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত: আজ দুপুরে খালেদা জিয়ার মরদেহ এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে জানাজাস্থলে নেওয়া ও জানাজার নামাজ ঘিরে বেশ কিছু সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামাজে জানাজা বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বাদ জোহর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ বুধবার সকালে নিম্নবর্ণিত রুটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় নেওয়া হবে।
এভারকোর হাসপাতাল-৩৬ জুলাই
এক্সপ্রেসওয়ে কুড়িল মাই গুলার এ নৌ সদর দপ্তর হয়ে বাসভবন ফিরোজা-গুলশান-২-কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ-এয়ারপোর্ট রোড-মহাখালী ফ্লাইওভার-জাহাঙ্গীর গেট-বিজয় সরণি- উড়োজাহাজ ক্রসিং হয়ে বামে মোড় নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের ৬ নম্বর গেট দিয়ে দক্ষিণ প্লাজা।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। পাশাপাশি কিডনি, ফুসফুস, হার্ট ও চোখের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাও ছিল তার। হার্ট ও ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে গত ২৩ নভেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসা তদারকি করেন। এই মাসের শুরুতে চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরবর্তীতে তা সম্ভব হয়নি।
বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক জীবনে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াও প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে তার জন্ম। তার বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে দেশভাগের পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন। তাঁদের আদি বাড়ি ফেনীতে । তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়। জিয়াউর রহমান বীর উত্তম রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বেগম জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে তার সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরে অংশ নেন। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং নেদারল্যান্ডসের রানী জুলিয়ানাসহ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৮১ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন ।
বেগম জিয়া দেশের রাজনীতিতে একটি অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। তিনি কখনো কোনো আসনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাঁচটি পৃথক আসন থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তিনটি আসনেই বিজয়ী হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরশাদ সরকার তার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং বহুবার আটক করে। তবুও খালেদা জিয়া এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান, হয়ে ওঠেন 'আপসহীন নেত্রী'।
বিকেপি/এনএ

