Logo

ধর্ম

স্মৃতিচারণ; পাঠের প্রথম প্রহর

Icon

হাতিম আল-ফেরদৌসী

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:১৯

স্মৃতিচারণ; পাঠের প্রথম প্রহর

দূরন্ত শৈশব বাঁধা-ধরার বাহিরে। ‘শিখতে হবে’ বলে শিশুকে কিছুই শেখানো যায় না। খেলাচ্ছলে যেটুকু গেলানো যায় তাই বেশ। মায়ের ঘুমপাড়ানো বিছানায় কালিমার পাঠ নিয়ে ছিলাম। অত:পর কয়েকটি সূরা ভাই-বোনদের থেকে শুনতে শুনতে শিখে নিলাম। বড় ভাই মাদরাসায় পড়তেন। বোর্ডিংয়ে থাকতেন। মাস-দেড়মাস পর বাড়িতে আসা হতো। 

আমিও মাদরাসায় পড়বো, স্বপ্ন লালন করতাম। পুরনো ছেড়া কাপড়, নারিকেলের খোসা ও মাটির ভাঙ্গা পাতিল বস্তায় ভরে টানতে টানতে উঠোনের কোণে গিয়ে সংসার গড়তাম। সংসারের নগদ অর্থ হিসেবে সাথে এক গাদা কাঠাঁলের পাতাও থাকতো। ভাটির পাতায় ধুলো আর নারিকেলের খোসায় ইটের গুঁড়োর মরচা রঙ্গের পানি নিতাম। কাল্পনিক ভাত-তরকারি খেতে বসতে বসতে বাড়ির প্রবেশপথে ভাইয়ের পাঞ্জাবির উপর যেই দৃষ্টি পড়তো, অমনি সোনার সংসার পায়ে দলিয়ে ‘ভাই আসছেন, ভাই আসছেন’ করতে করতে ছুটে চলতাম।

ছুটি কাটিয়ে মাদরাসায় ফিরে যাওয়ার সময় ভাইয়ের সাথে যাওয়ার জন্য আমার চঞ্চল মন ব্যাকুল হয়ে উঠতো। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরতাম ভাইয়ের হাতে। আমাকে নিয়ে যাও আমাকে নিয়ে যাও আর্তধ্বনি। এমনি একদিন বাবা একটু বিরক্ত হয়ে ভাইকে বললেন, নিয়ে যা একে। আমি আনন্দে আত্মহারা। তড়িৎ প্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমাকে সঙ্গে নিতে ভাইও ভেতর থেকে প্রস্তুত। মাদরাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। বাসে জীবনে চড়িনি। এতো দূর্গন্ধ বাসে হয় তা আগে ভাবিনি। বোমি করতে হয়েছে অনেক বার। ক্লান্ত দেহ। মন শুধু চায়, বিছানাটা পেলেই ঢলে পড়ি। 

বয়স তখন পাঁচ-ছয় । শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। এখন আমি আইনের আওতায়। স্বাধীন জীবনের এই সমাপ্তি। মূহুর্তে মূহুর্তে বাড়ির ছবি স্মৃতিতে আয়নার মতো ভাসে। বাড়ির মায়া, মা-বাবার ভালোবাসা, সমবয়সীদের সাথে খেলা এসব আমি হারিয়েছি। চলছে মনের গহীনে নিরব রূদন। সব মিলিয়ে আমার লেজেগোবরে অবস্থা। মাদরাসা মাদরাসা করে লাফানোর আগের সেই স্বাদ এখন আর নেই। তবু পড়তে হবে। ভর্তি যখন হয়েছি তো পড়তে হবে । বই পড়া শুরু। এক দুই তিন, অ ই ঈ, অ আ ই ঈ, ক খ গ আর ا ب ت ث -র বই। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের প্রথম বই পাঠের অভিজ্ঞতা কেমন হবে তা তো জানাই। ভাইয়ের সাথে বোর্ডিংয়ে থাকতে হচ্ছে। বাড়ির জন্য মন পাগল। ব্যাথা ভরা মন। অশ্রুসিক্ত চোখ। 

চলে গেলো কয়েকদিন। ভাই আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন। দু-একদিন থেকে আবার চলে যেতে হচ্ছে। এভাবে ঘন ঘন যাওয়া আসা করে কয়েক মাস চলে গেলো। মাদরাসায় গেলেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এবার বাবা আমাকে আর মাদরাসায় দিতে রাজি নন। বলেন, গ্রামের স্কুলে দু’এক ক্লাস পড়–ক তার পর মাদরাসায়। আমার আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু কই, স্কুলেও তো ধরা-বাঁধা। সবাই বলে, লেখা-পড়া ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না। তাই আমাকে পড়তেই হবে। শুরু হলো বাধ্যবাধকতার পড়া। তিন বছর পর আবার মাদরাসায় ভর্তি হলাম ৩য় শ্রেণীতে। 

মনের অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। এখন চলছে প্রতিযোগিতার পড়া। আমাকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে, এই মনোভাবের পড়া। সাথে আছে বড় ভাইয়ের দেওয়া উৎসাহ। পড়া হয়ে গেলো এখন মনের খোরাক, আনন্দের রসদ। এ মাদরাসায় ছাত্রপাঠাগার আছে। ক্লাসের বইয়ের বাইরে অন্য কিছু পড়তে ছাত্ররা নির্ধারিত তারিখে পাঠাগারে ভিড় করতো। আমারও মনে স্বাধ জাগলো এমন কিছু পড়ার।

আল্লামা কামাল উদ্দীন দামেরীর লেখা “হায়াতুল হায়াওয়ান” (বাংলায় অনুদিত) বইটি নজরে পড়ে। নিয়ে নিলাম বইটি। প্রাণীকুলের বিবরণী আছে এটাতে। বইটি মূল আরবী। আরবী হরফের ধারাবাহিকতায় হায়াওয়ানাতের নাম আনা হয়েছে । নামের বিশ্লেষণ, প্রাণীর বৈশিষ্ট্য, চিকিৎসা গুণাগুণ, কোন প্রাণী স্বপ্নে দেখলে কী তাবীর, এতদসংশ্লিষ্ট কোরান-হাদিসের ভাষ্য ছাড়াও বইটিতে আছে প্রাসঙ্গিক নানান মজাদার কাহিনী। কয়েক দিন সময় নিয়ে অবসরতার ফাঁকে ফাঁকে প্রথম খন্ড সমাপ্ত করে নিলাম। 

আমার মনোজগতে নাড়া দেওয়ার মতো এটিই ছিলো প্রথম গ্রন্থ। বইটি পড়ে যেনো দুনিয়াকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছি। ইতিপূর্বে স্কুলে থাকাকালীন কোনো বই একক ভাবে মন না কাড়লেও কিছু গল্প, কিছু কবিতা আর বইয়ে আঁকা কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য মন কেড়েছে দারুণভাবে। এসব শুধু আমার ক্লাসেরই ছিলো না, প্রায়ই ছিলো অন্যান্য ক্লাসের। ৫ম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে হ্যামেলীনের বাঁশীওয়ালার কথা মনে পড়ে। বাঁশীওয়ালা শর্ত মতো যখন তার প্রাপ্য পেলো না, তখন বাঁশিতে ভিন্ন মাত্রার সুর তুলে পাড়ার শিশুদের মাতাল করে নিয়ে নদিতে নিক্ষেপ করে। সেই বইটিতে বাঁশিওয়ালার ছবিও কাল্পনিক ভাবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আঁকা ছিলো।

মনে আসল আহসান হাবীবের “স্বদেশ” কবিতার কথা। কোন ক্লাসের বইয়ে তা মনে নেই। কবি বলেন,

“এই যে নদী

নদীর জোয়ার

নৌকা সারে সারে,

একলা বসে আপন মনে

বসে নদীর ধারে

এই ছবিটি চেনা।

মনের মধ্যে যখন খুশি

এই ছবিটি আঁকি

এক পাশে তার জারুল গাছে

দু’টি হলুদ পাখি,

এমনি পাওয়া এই ছবিটি

কড়িতে নয় কেনা”।

এই কবিতাটির পাশে ছিলো জারুল গাছ, আর গাছের পাশে উড়ন্ত দুটি পাখির ছবি, যা আমার মন সহজেই কেড়েছিলো। এভাবে, কুসুম কুমারী দাসের “আদর্শ ছেলে  কবিতা”, অতুল প্রসাদ সেনের “বাংলাভাষা” কবিতা , হুমায়ুন কবিরের “মেঘনায় ঢল” কবিতা, রবীন্দ্রনাথের “আমাদের ছোট নদী” আমার মনে ভাবনার স্পন্দন জাগায়। শৈশবের স্মৃতি এখনও তাড়িত করে। 

লেখক : কবি ও কওমি মাদরাসা শিক্ষক

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর