১ ট্রিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে এখনো প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ

ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৫৪

ছবি : ইউএনবি
প্রযুক্তির এই অভাবনীয় বিকাশের যুগে অনন্য সম্ভাবনাময় একটি অর্থনৈতিক খাত হয়ে উঠেছে সেমিকন্ডাক্টর। এই খাত ২০৩৩ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আয়ের প্রত্যাশা করছে। অথচ বিনিয়োগহীনতা ও পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশ এখনো বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতই নয়।
বর্তমান সরকারসহ আগেও কয়েক দফায় এই শিল্প গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কথার ফুলঝুরি ছাড়া কোনো বাস্তব অগ্রগতি হয়নি। এশিয়াজুড়ে যখন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
গত অর্থবছরে সেমিকন্ডাক্টর খাত থেকে বাংলাদেশে মাত্র ৮ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে, তাও মূলত ফ্রিল্যান্সার ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের ফল।
এশিয়ার অন্যান্য দেশে এই শিল্পের বিকাশে সরকারি প্রণোদনা বড় ভূমিকা রেখেছে। অনেক দেশে কর ছাড়, জমি বরাদ্দ, এমনকি ভর্তুকিও দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ন্যানোম্যাটেরিয়ালস ও সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এএসএমএ হাসিব বলেছেন, এই খাতে সবচেয়ে সফল দেশের মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম। এসব দেশে সরকারের বড় সহায়তা ছিল। বাংলাদেশকেও সফল হতে হলে কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক ভর্তুকি ও শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তির মূলভিত্তি সেমিকন্ডাক্টর
সেমিকন্ডাক্টরকে আধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি একদিকে পরিবাহক, অন্যদিকে নিরোধক হিসেবে কাজ করে ডিভাইসের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই উপাদান লাখো কোটি সংখ্যায় একেকটি ডিভাইসের অংশ হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের শিক্ষক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার মিলার তার ২০২২ সালে প্রকাশিত বই চিপ ওয়ার-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টরের মূল্য তেলের চেয়েও বেশি হবে।
তিনি বলেছিলেন, আধুনিক যুগে একজন মানুষ স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করে দৈনিক ৬০–১১০ বিলিয়ন সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করছে।
সেমিকন্ডাক্টরের কারণেই সিলিকন ভ্যালি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের স্বর্ণভূমি হয়ে উঠেছে। প্রথমদিকে সেখানে নিজস্ব চিপ তৈরি হলেও পরে ব্যয় কমাতে প্যাকেজিং, ডিজাইন ও উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপ এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়।
অ্যাপলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেমোরি চিপ আসে জাপান থেকে, রেডিও চিপ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে, অডিও চিপ টেক্সাস থেকে; তবে প্রসেসর তৈরি হয় তাইওয়ানে আর স্মার্টফোন সংযোজন হয় চীন ও ভারতে।
১৯৪৭ সালে ট্রানজিস্টরের আবিষ্কার সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের সূচনা ঘটায়। তারপর থেকে এর চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে।
এশিয়ায় সেমিকন্ডাক্টরের দাপট
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি তাইওয়ানে অবস্থিত, যারা ১৯৯০-এর দশক থেকেই উৎপাদন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মোট বিনিয়োগ এ বছর পৌঁছাবে ১৬৫ বিলিয়ন ডলারে। তাইওয়ানের বার্ষিক উৎপাদন এখন এক কোয়াড্রিলিয়ন সেমিকন্ডাক্টর। দেশটির সরকার ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ৯৩০ কোটি ডলার ভর্তুকি ঘোষণা করেছে।
ভিয়েতনাম ২০১০ সালে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প চালু করে এবং ইতোমধ্যেই ১ এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার রাজস্ব আয় করেছে। দেশটি মূলত প্যাকেজিং, টেস্টিং ও ডিজাইনিংয়ে যুক্ত। ২০২৪ সালে ভিয়েতনাম প্রায় ১৭৪টি এফডিআই প্রকল্প আকর্ষণ করেছে, যার পরিমাণ ছিল ১১৬০ কোটি ডলার। একই বছরে দেশটির সরকার এই খাতে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
ভারত ১৯৭০-এর দশকে এই শিল্পে প্রবেশ করে। দেশটির লক্ষ্য ২০২৫ সালে সর্বোচ্চ ৫ হাজার কোটি ডলার এবং ২০৩০ সালে ১০ হাজার কোটি ডলার আয়ের। গত আগস্টে ভারত ৭০০ কোটি ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে।
২০২৪ সালে মালয়েশিয়া ১৩ হাজার কোটি ডলারের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করেছে, যা ১৯৭০-এর দশক থেকেই গড়ে ওঠা শিল্পের ফল।
চীন ২০২৪ সালে ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করেছে, এর আগে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে।
বাংলাদেশের অবস্থান
এদিকে বাংলাদেশ এখনো এই খাতে প্রবেশের কোনো পরিকল্পনাই তৈরি করতে পারেনি।
প্রতিবছর ইলেকট্রিক্যাল-ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রিধারী প্রায় ২ লাখ প্রকৌশলী কর্মসংস্থানের সংকটে পড়েন।
অধ্যাপক হাসিব বলেন, যদিও বাংলাদেশ এখনো উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত নয়, তবে প্যাকেজিং বাজারে প্রবেশ করতে পারে। কম খরচের কারণে অনেক দেশ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) পাঁচ বছরের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। আগের সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রতিস্থাপন করা বর্তমান সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কিছু কৌশল গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জানান, বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ মূলত প্রচলিত খাতগুলোতে সীমিত। গার্মেন্টসের চেয়ে সেমিকন্ডাক্টরে দেশে বিনিয়োগ বেশি প্রয়োজন। এতে একক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে। এজন্য আলাদা বিনিয়োগ মডেল দরকার বলে মনে করেন তিনি।
বিডার ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, সেমিকন্ডাক্টর বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন খাত। বিনিয়োগ আকর্ষণে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তাব দরকার।
তিনি জানান, প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ চলছে। বিডা এই খাতে বড় বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখছে বলেও উল্লেখ করেন বিডার এই কর্মকর্তা।
সূত্র : ইউএনবি
এএ