ট্রাম্পের ১০০ দিনে অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে গেল গোটা বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৭

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০০ দিন /সংগৃহীত ছবি
একশ দিন আগে, আমেরিকা সেই বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছিল, যা তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছিল। এই ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে বিশ্বব্যাপী সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি আমেরিকার আধিপত্য বজায় থাকে।
ভয়াবহ করোনা মহামারির পর মার্কিন অর্থনীতি অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়েছিল। যদিও বেশিরভাগ আমেরিকান সেই সুফল ততটা অনুভব করেননি। যার ফলে আগের বাইডেন প্রশাসন নির্বাচনে পরাজিত হয়।
তারপরও, বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল পুনরুদ্ধারে আমেরিকা নেতৃত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু এখন সবকিছু অনিশ্চিত।
যদিও ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে, এই ১০০ দিন তিনি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের দৃষ্টিতে, বহু প্রশংসিত পুরনো বিশ্বব্যবস্থা আমেরিকাকে ঠকিয়েছিল। ট্রাম্প যথার্থভাবেই এর প্রতিশোধ নিচ্ছেন।
তিনি বিশ্বের অনেক দেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার ব্যতিক্রমী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক মিত্ররাই আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকিয়েছে, ফলে তাদেরকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি এমন পর্যায়ে আঘাত হেনেছে যে, আমেরিকার আগের দুর্দান্ত মুদ্রা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আস্থা ভেঙে পড়েছে।
শেষ মুহূর্তের এক বিব্রতকর আংশিক পশ্চাদপসরণ ছাড়া বন্ড বাজারের ভয়াবহ ধস ও ডলারের ওপর এর পরিণতি এড়ানো সম্ভব হতো না।
ট্রাম্পের ব্যতিক্রমী কৌশল
সমালোচকদের মতে, কাল্পনিক শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ট্রাম্প আসলে নিজেকেই গুলি করছেন। ট্রাম্পের কূটনীতি আর ক্ষমতার ব্যবহারও একইভাবে ব্যতিক্রমী।
তিনি যেন এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা’-তে বিশ্বাস করেন—যেখানে শক্তিশালীরা শাসন করবে, আর দুর্বলরা নিজের ভাগ্য মেনে নেবে। ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড ও পানামা দখলের কথা বলেছেন —যেন এগুলো আমেরিকার ভবিতব্য। কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্যে পরিণত করার কথাও উল্লেখ করেছেন।
তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। উল্টো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে দোষারোপ করেছেন।
মিত্রদের আতঙ্কিত করেছেন ট্রাম্প
জাতিসংঘে মার্কিন কূটনীতিকদের মস্কোর পক্ষে ভোট দিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। হোয়াইট হাউজে ইউক্রেনীয় নেতাকে প্রকাশ্যে হেয় করেছেন, যেখানে তার সহকারী হিসেবে ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স।
ট্রাম্প যে শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন, তা এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে মনে হয় এটি ক্রেমলিনে লেখা হয়েছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিকল্পনায় তাদের খনিজ সম্পদ থেকে শুরু করে দখলকৃত বিশাল এলাকা ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে—যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে গুরুতর আগ্রাসনের নিদর্শন।
বৃহত্তর পরিসরে, ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইউরোপে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির দীর্ঘদিনের গ্যারান্টর হিসেবে আমেরিকার ভূমিকা কমে আসবে।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় অন্যান্য দেশগুলোকেও নিজেদের স্বার্থ আগে দেখতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সমালোচকরা বলছেন, এর ফলে বিশ্ব আবার দুর্গের মতো আত্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ফলে শান্তি ও সহযোগিতার পরিবর্তে বাড়বে সংঘাত ও বিভেদ।
বিদ্রূপাত্মকভাব বলা হয়, বিশ্বব্যবস্থায় ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। অথচ ট্রাম্পের চরমপন্থী নীতিমালা এখন সেই সাফল্যকেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ইতোমধ্যেই মার্কিন জনগণ মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্যের ঘাটতির শিকার হতে শুরু করেছেন।
‘সফট পাওয়ার’-এর বিলুপ্তি
ট্রাম্পের প্রশাসন আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম ‘সফট পাওয়ার’ ইউএন এইড বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকিতে পড়েছে এবং চীন সেই শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ করতে আগ্রহী।
একই সঙ্গে, দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ আমেরিকার মর্যাদা আরও ক্ষুণ্ণ করেছে।
তিনি বিচারকদের আক্রমণ করছেন, নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচক একাডেমিক, মিডিয়া, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসহ আইন সংস্থাগুলোর ওপর চড়াও হচ্ছেন।
আরও উদ্বেগজনক হলো, ট্রাম্প ‘হোমগ্রোন’ বা জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকদের মধ্য আমেরিকার একটি কুখ্যাত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সরকারের পরিচালিত বন্দিশিবিরে নির্বাসন দিয়েছেন। এভাবে, আমেরিকার নৈতিক নেতৃত্বের দাবি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘আর নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়’
এই প্রশাসন আমেরিকার নৈতিক নেতৃত্বের দাবিকে কলঙ্কিত করেছে।
মিত্র দেশগুলো এখন আর আমেরিকাকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার বলে মনে করছে না এবং তারা তা প্রকাশ্যেই বলছে।
কিছু বিশ্লেষক আশা করছেন, জনপ্রিয়তা ও বিতর্কের চাপে পড়ে ট্রাম্প নীতিতে নমনীয় হবেন। যেমনটা তিনি শুল্কনীতির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে করেছেন।
তবে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রথম মেয়াদের তুলনায় আরও বেশি দৃঢ়সংকল্প ও চরমপন্থী মনোভাব দেখাচ্ছেন।
মিত্ররা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাকে সংযত ও প্রভাবিত করার জন্য, কিন্তু মাত্র ১০০ দিনে আমেরিকা ও গোটা বিশ্ব অপরিবর্তনীয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে।
স্কাইনিউজ/ওএফ