পুরো গাজা দখলের নীল নকশা, বড় অভিযান চালাবে ইসরায়েল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ০৮:২৩

গাজা দখল ও সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে ইসরায়েল /ছবি : সংগৃহীত
ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান জোরদার করার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। যার মধ্যে গাজা দখল ও সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য হামাসকে ধ্বংস করা ও বাকি জিম্মিদের উদ্ধার করা।
তিনি বলেন, গাজার ২১ লাখ জনগণকে সুরক্ষার জন্য সরিয়ে নেওয়া হবে।
কতটুকু এলাকা দখলে নেওয়া হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে জোর দিয়ে বলেন, ‘তারা (সেনা) গাজায় ঢুকবে কিন্তু চলে আসবে না; তারা সেখানে অবস্থান করবে।’
এছাড়া মন্ত্রিসভা নীতিগতভাবে এমন একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে যাতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ শুরু করা হবে। এই উদ্যোগটি দুই মাস ধরে চলা অবরোধের অবসান ঘটাবে।
জাতিসংঘ গাজায় তীব্র খাদ্য সংকটের কথা জানিয়েছে। তবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থা এই প্রস্তাবকে মানবিক নীতিমালার লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করে এতে সহযোগিতায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
হামাসের এক কর্মকর্তা বলেন, গাজায় ইসরায়েলের এই চাপ প্রয়োগ ও ব্ল্যাকমেইল তারা প্রত্যাখ্যান করছে।
ইসরায়েলের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করবেন।
যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, ‘তারা গাজায় ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযানের সম্প্রসারণকে সমর্থন করে না।’ এর আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কতা প্রকাশ করে বলেছিল, এই পদক্ষেপে ‘আরও প্রাণহানি ও ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে’।
রোববার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজায় অভিযান নিয়ে বৈঠক করে। দুই মাসের অস্ত্রবিরতি শেষ হওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অভিযান নিয়ে আলোচনা হয়।
সোমবার সকালে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন । তিনি জানান, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ায়েল জামিরের প্রস্তাব করা পরিকল্পনাটি মন্ত্রীরা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেছেন। পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো ‘হামাসকে পরাজিত করা ও জিম্মিদের উদ্ধার করা।’
তিনি বলেন, ‘এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে গাজা দখল ও সেখানে ইসরায়েলি অবস্থান। গাজার জনগণকে দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়া ও হামাসকে মানবিক সহায়তা বিতরণ থেকে বিরত রাখা। সর্বোপরি হামাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালানো।’
ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে গাজার অতিরিক্ত এলাকা দখল করা হবে এবং ইসরায়েল ঘোষিত ‘বাফার জোন’ আরও বড় করা হবে। এতে হামাসের সঙ্গে একটি নতুন অস্ত্রবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তিতে ইসরায়েল আরও সুবিধাজনক অবস্থানে যাবে।
পরে এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, ১৩ থেকে ১৬ মের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ হওয়ার আগে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হবে না। এই সময়টুকু হামাসের জন্য ‘একটি সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে যাবেন।
এদিকে, চরম ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ সোমবার জেরুজালেমে এক সম্মেলনে বলেন, ‘ইসরায়েল এবার গাজা উপত্যকা পুরোপুরি দখল করতে যাচ্ছে।’
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে একতরফাভাবে সেনা ও ইসরায়েলি বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়। তবে জাতিসংঘ এখনো গাজাকে ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চল হিসেবেই বিবেচনা করে। কারণ ইসরায়েল এখনো এর সীমান্ত, আকাশপথ ও উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।
সোমবার রাতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, সম্প্রসারিত এই অভিযান গাজার অধিকাংশ ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে দেবে এবং বিমান হামলা ও অন্যান্য সামরিক অভিযান চলতে থাকবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, দীর্ঘ সামরিক অভিযানেও এখনো ৫৯ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা যায়নি—যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত থাকতে পারেন বলে ধারণা। তারা হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
জিম্মিদের স্বজনদের প্রতিনিধিত্ব করা ‘হোস্টেজেস অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম’ নামের একটি সংগঠন এই পরিকল্পনাকে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ভূখণ্ডের চেয়ে জিম্মিদের কম গুরুত্ব দেওয়া’ বলে অভিহিত করেছে।
তারা বলেছে, ‘ইসরায়েলের ৭০ শতাংশ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত।’
হামাস কর্মকর্তা মাহমুদ মারদাওয়ি বলেন, তারা একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি চায়, যাতে থাকবে ‘সম্পূর্ণ অস্ত্রবিরতি, গাজা থেকে ইসরায়েলের পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার, গাজার পুনর্গঠন ও উভয় পক্ষের সব বন্দির মুক্তি।’
উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিরা বিবিসিকে বলেন, আবারও জোরপূর্বক দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার তারা বিরোধিতা করছেন। অনেকে বলেন, নিজেদের ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপে থেকেই মরতে রাজি তারা।
৭৬ বছর বয়সী গাজা সিটির বাসিন্দা আহমেদ শেহাতা বলেন, ‘২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে আমি আমার সন্তান, মেয়েরা ও নাতিপুতি—মোট ৬০ জনকে নিয়ে গাজা ছেড়েছিলাম। দক্ষিণে যে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ বলে ইসরায়েল দাবি করেছিল, সেখানে আমরা অমানবিক পরিস্থিতিতে ছিলাম। এবার আমরা আর যাব না, ইসরায়েল যদি আমাদের মাথার ওপর তাঁবু ভেঙে ফেলে তাও না।’
৪৮ বছর বয়সী ও পাঁচ সন্তানের পিতা ওসামা তাওফিক বলেন, ‘ইসরায়েলের হুমকি আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না। আমরা গাজাতেই থাকব।’
ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রিসভা বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি পরিকল্পনাও অনুমোদন করেছে যাতে ‘মানবিক ত্রাণ বিতরণ প্রয়োজনে এভাবে পরিচালিত হবে যাতে হামাস তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এবং তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা ধ্বংস হয়।’
তিনি বলেন, সামরিক অভিযান শুরু হলে ত্রাণ সরবরাহ পুনরায় চালু হবে। সেনাবাহিনী দক্ষিণ রাফাহ অঞ্চলে একটি ‘নিরাপদ এলাকা’ তৈরি করবে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের যাচাই করে প্রবেশ করানো হবে।
রোববার জাতিসংঘের মানবিক ও সহযোগী সংস্থাগুলোর ফোরাম ‘হিউম্যানিটারিয়ান কান্ট্রি টিম’ (এইচসিটি) জানায়, ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বর্তমান ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে চায় ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলি কেন্দ্রের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ পরিচালনায় সম্মত হতে বলছে।
এইচসিটি সতর্ক করেছে, এই পরিকল্পনার ফলে গাজার বড় অংশের, বিশেষ করে চলাচলে অক্ষম ও দুর্বল জনগণ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হবে।
তারা বলেছে, ‘এটি মৌলিক মানবিক নীতির পরিপন্থী। জীবনরক্ষাকারী সামগ্রীকে একটি চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখায়। এটি বিপজ্জনক—নাগরিকদেরকে সামরিক এলাকায় রেশন নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যাতে তাদের জীবন ও ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। এতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি আরও গভীর হচ্ছে।’
অস্ত্রবিরতির দুই সপ্তাহ আগে গত ২ মার্চ থেকে গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা ও পণ্য সরবরাহ বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল।
জাতিসংঘ বলছে, গাজায় জনসংখ্যা এখন আবার অনাহার ও অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়েছে। কারণ গুদামগুলো খালি, বেকারিগুলো বন্ধ ও কমিউনিটি কিচেনের মাত্র কয়েকদিনের মজুত রয়েছে।
এই অবরোধে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য জরুরি ওষুধ, টিকা ও চিকিৎসা সরঞ্জামও বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘ বলছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইসরায়েল গাজার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। তবে ইসরায়েল বলছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলছে এবং সহায়তার কোনো ঘাটতি নেই।
গত ৭ অক্টোবর ২০২৩, হামাসের এক নজিরবিহীন সীমান্ত পারাপারের হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর জবাবে ইসরায়েল হামাস ধ্বংসে অভিযান শুরু করে।
গাজার হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় কমপক্ষে ৫২ হাজার ৫৬৭ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২ হাজার ৪৫৯ জন ইসরায়েলের অভিযান পুনরায় শুরুর পর মারা গেছেন।
বিবিসি/ওএফ