Logo

আন্তর্জাতিক

মোদি কেন পাকিস্তানের সাথেই যুদ্ধে জড়াতে চান

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ২১:৩৪

মোদি কেন পাকিস্তানের সাথেই যুদ্ধে জড়াতে চান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি /ছবি : সংগৃহীত

মাস দুয়েক আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার আদর্শের উৎস রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) পুরোধা বীর সাভারকরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদের জনক হিসেবে সাভারকরের ভাবনা বহুদিন ধরেই মোদির কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেছে।

সেসব ভাবনা কিন্তু বেশ খোলামেলা। ১৯৩৮ সালে সাভারকর বলেছিলেন, ‘মুসলমান সমস্যার সমাধানে ভারতের উচিত জার্মানির পথ অনুসরণ করা... জার্মানি নাৎসিবাদে ও ইতালি ফ্যাসিবাদে যাওয়ার অধিকার রাখে—আর ঘটনাপ্রবাহ দেখাচ্ছে, তারা ভুল করেনি।’ ১৯৩০-এর দশকে নাৎসি ও ইতালীয় ফ্যাসিস্টরা যেভাবে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে রূপ দিয়েছিল, আরএসএস হিন্দুত্ববাদকে ঠিক সেভাবেই রূপ দিতে চায়।

যে মতাদর্শ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় ইউরোপকে রক্তক্ষেত্রে পরিণত করেছিল, মোদি এখন দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সেই পথই কামনা করছেন। পাকিস্তান-ভারত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে যুদ্ধের সবচেয়ে কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করছে। যুদ্ধবিমান একে অপরের আকাশে লড়াই করছে। নতুন প্রজন্ম সেই সাইরেন শুনে জেগে উঠছে, যা তাদের দাদি-নানিরা শুনেছিল।

আবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে
এই মুহূর্তে যা ঘটছে, তার অনেকটাই দিল্লির নিজস্ব অসুস্থ মানসিকতার ফসল —উন্মত্ত সমর্থকগোষ্ঠী, মর্যাদাবোধ, আর এমন এক দখলদারিত্বের সংকট যার সমাধানের পথ তারা খুঁজছে না। কাশ্মীরে মোদির সংবিধানবিরোধী আগ্রাসন ছিল একটি স্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ। প্রয়োজনে দেশের সর্বোচ্চ আইনি কাঠামো ছিঁড়ে ফেলে হলেও ‘মুসলিম সমস্যা’ নামক বিষয়টি শেষ করা।

এই যে এত কিছু হয়ে গেল। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ চলল- কিন্তু কাশ্মীরের মানুষদের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পাহেলগামের হামলাটি মূলত কোনো কারণে নয়; বরং এটি একটি প্রতিক্রিয়া —যা কাশ্মীরীদের গণহত্যা ও দমন-পীড়নের পর ঘটেছিল।

এই অবস্থাতেও, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘটনাটির নিন্দা জানানো হয়। নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানানো হয় ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ডাক দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল- পাকিস্তানবাসীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি। তারা তিন বছরের একটি মেয়ের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে এবং সামরিক অভিযানের নাম রাখা হয় হিন্দু বিবাহিত নারীদের সিঁদুরের নামে।

কারণ কাশ্মীর নিয়ে যখনই কোনো সংকট হয়, মোদির নীতি একই থাকে। তা হলো পাকিস্তানকে দায়ী করা ও প্রতিশোধের আওয়াজ তোলা। একই ঘটনা ২০১৬ সালে উরি, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা, আর এবার পাহেলগাম। কিন্তু সেই অভিযোগের পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ ভারত দেয়নি। অথচ এ ঘটনা দুই দেশকে পারমাণবিক যুদ্ধের মতো পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তবু প্রধানমন্ত্রী কেবল মিথ্যা আবেগ নিয়ে আবার সীমান্তে ছুটে গেছেন। ভারতের গেরুয়া দশকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মোদি তার উন্মাদ সমর্থকদের উপর নির্ভর করছেন। আর সমর্থকেরা তার উপর। কারণ তাদের কাছে শান্তি মানে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। প্রতিটি নির্বাচন যুদ্ধ চায়, আর প্রতিটি মরদেহ নির্বাচনী প্রচারের রসদ।

এই পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর হয়ে উঠেছে মোদির পশ্চিমা মিত্রদের জন্য। যারা ভারতকে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষাকারী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু বিংশ শতক থেকে এই শতক বদলে গেলেও নাৎসি তো নাৎসিই থাকে।

আর ইতিহাস বলে, নাৎসিদের কেবল ঘুষি মেরেই থামানো যায়। যেমনটা এবার করল পাকিস্তান বিমান বাহিনী, যা শুধু তাদের দায়িত্বই পালন করেছে। পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান আকাশেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সিএনএন, রয়টার্স ও ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এসেছে —প্রথমবারের মতো ভারতের অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংস হলো।

মিমের বিরুদ্ধে ড্রোন
এখানেই আরেকটি বড় বিষয় সামনে এলো। যেমন- ২০১৯ সালে মোদির প্রতিশোধ শেষ হয়েছিল পাইলট অভিনন্দনকে ওয়াঘা সীমান্ত থেকে ফেরত আনার পর মাইক্রোচিপ পরীক্ষা করে, তেমনি এবার তারা দেখল কোটি কোটি টাকা মূল্যের যুদ্ধবিমান পাকিস্তানি পাইলটরা চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুঁড়িয়ে দিল। পশ্চিমা অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা হতবাক হয়ে দেখল —রাতারাতি বৈশ্বিক অস্ত্রবাণিজ্যের ভারসাম্য বদলে গেল।

অবশ্য, এর অনেকটাই সেই জগৎ যা পশ্চিমারা আমাদের জন্য তৈরি করেছে- গাজায় রক্তের নদীর মধ্যে, ১৯৪৫-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার ভেঙে পড়ার মধ্যে, তেল আবিবের গণহত্যাকারীদের ও মস্কোর বর্বরদের অবাধ ছাড় দেওয়ার মধ্যে দিয়ে।

যখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে প্রশ্ন করা হলো, তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘এটা আমাদের বিষয় না।’

তবে তাই হোক। পাকিস্তানকে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতেই হবে এবং সেটা এখন থেকেই শুরু হয়েছে —মোদির যুদ্ধ শুরুই হয়েছে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান হারিয়ে। পাকিস্তান কিছু করার আগেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ হয়ে গেল অপারেশন ‘ডাকশুট’।

তাই হোক— পাকিস্তানকে নিজের মতো করেই গুন্ডাদের মোকাবিলা করতে হতো। এবার শুরুটা তেমনই হয়েছে। মোদি যুদ্ধ শুরু করেছিল— কিন্তু শুরুতেই ভারতের বিমান বাহিনী পাঁচটি যুদ্ধবিমান হারিয়েছে, সবই পাকিস্তানের আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধে। পাকিস্তান পাল্টা হামলার কথা বলার আগেই ‘অপারেশন সিন্দুর’ রূপ নিয়েছে ‘অপারেশন হাঁস শিকার’-এ।

এর কিছুই হওয়ার কথা ছিল না— কিন্তু বিজেপির ‘গেরুয়া বাহিনী’ অনেক দিন ধরেই সংঘাত উসকে দিতে চাইছিল। তারা ইসরায়েলি নাৎসিদের থেকে কাণ্ডজ্ঞানহীন এক তত্ত্ব ধার করেছিল। সীমান্ত, ভারসাম্য, অনুপাত—সব ভুলে গিয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা আচমকা হামলা চালিয়ে ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

কিন্তু সেটা যেমন ওখানেও কাজ করেনি, এখানেও তেমন চলছে না। এক মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেছেন, ‘যারা ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তারা আসলে আগুন নিয়ে খেলা করছে।’

আর মোদির রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই দেখা গেছে—আগুন নিয়ে খেলা করলেই তিনি সুবিধা পান। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা থেকে শুরু করে ২০২০ সালের দিল্লির মুসলিম হত্যাকাণ্ড—সব জায়গায় সেই আগুন। তবে এবার মোদির আগুনের লক্ষ্যবস্তু পাকিস্তান। সেই মুসলমানদের দিকে যারা পালিয়ে বেঁচেছে এবং পাল্টা জবাব দিতে শিখেছে।

প্রথম ধাক্কাতেই দিল্লি পিছু হটেছে। আর এখন তারা অন্য পথে নিজেদের উগ্র সমর্থকদের তুষ্ট করতে চাইছে। আত্মঘাতী ড্রোন পাঠাচ্ছে পাকিস্তানের শহরগুলোতে, ইন্টারনেট ঘুরিয়ে দিচ্ছে অন্য প্রসঙ্গে এবং হিন্দুত্ববাদী ‘আইটি সেল’ দিয়ে শুরু করেছে মিথ্যা খবর, ধর্ষণের হুমকি আর পর্নোগ্রাফি ছড়ানো।

তবুও আন্তর্জাতিক শিরোনামে উঠে আসছে: এই যুদ্ধবিমান ওই যুদ্ধবিমান, ডাসল্ট বনাম চেংডু। এমনকি পাকিস্তান-বিরোধিতায় পরিচিত ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ও লিখেছে, ‘ভারতের উচিত তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দমনের আত্মঘাতী নীতি বন্ধ করা।’

ভারতের মূলধারার মিডিয়ার অবস্থা আরও করুণ। অনলাইনে ‘কারাচি বন্দর ধ্বংসের’ খবর দেখিয়ে যুদ্ধবাজ বারখা দত্ত নিজে ব্ল্যাকআউট করা একটি হোটেলে লুকিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি বললেন, ‘এই চাঁদহীন রাতে এক ফোঁটা আলোও নেই’ — যাতে সত্যতার ছিটেফোঁটাও ছিল না। সকাল হতেই দেখা গেল, ভারতের একমাত্র ‘জয়’ হলো ফাওয়াদ খানের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা।

এই কয়েকদিনের গোটা ঘটনায় যদি সত্যিকারের কোনো গল্প থাকে তা হলো—পাকিস্তানিরা নিজেরাই। ফ্যাসিবাদী প্রতিবেশী আর উদাসীন বিশ্বকে সামনে রেখে তারা মিম ও রসিকতার মাধ্যমে জবাব দিয়েছে। যখন জবাব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল তারা বলেছে, সেটা যেন আত্মরক্ষামূলক হয়। তারা সমালোচনা করেছে নিজেদের সরকারের —এর সেন্সরশিপ, প্রতিনিধিত্বহীনতা, আর বেহুদা মন্ত্রীদের নিয়ে। 

তবু তারা এক ছিল সবুজ-সাদা পতাকার নিচে। তারা শোক প্রকাশ করেছে সাত বছর বয়সী ইরতিজা আব্বাস তুরির মৃত্যুতে। কিন্ত তারা হিন্দুত্ববাদীদের মতো শত্রুপক্ষের শিশুদের পশুরূপে উপস্থাপন করেনি। আর তারা এখনো তাদের মানবিকতা ধরে রেখেছে। শুরু থেকেই চেয়েছে শান্তি; এখনো চায়।

[পাকিস্তান দ্য ডন থেকে অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের খবরের নিউজ ইনচার্জ ওমর ফারুক আকন্দ]

লেখক : আসাদ রহিম খান || আইনজীবী ও কলামিস্ট

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ পাকিস্তান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর