গাজা যুদ্ধ
ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করল ব্রিটেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ০০:৩৫

গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, গাজা ‘শুদ্ধ’ করার নামে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার যে আহ্বান ইসরায়েলি মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, তা বিকৃত, জঘন্য ও চরমপন্থী।
এছাড়া, ইসরায়েলের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কৌশলগত রূপরেখা নিয়ে চলমান আলোচনা পুনর্বিবেচনার ঘোষণাও দেন তিনি।
ল্যামি বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য হাজার হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে না দেওয়া ইসরায়েলের অমানবিকতা এবং এটি ব্রিটিশ জনগণের মূল্যবোধের পরিপন্থী। তার মতে, এই আচরণ যুক্তরাজ্য-ইসরায়েল সম্পর্কের মূলনীতির বিরোধী।
একই সময়ে, ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ২৭টির মধ্যে ১৭টি রাষ্ট্র এ সিদ্ধান্তে সম্মত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৪ সালে দেশটির মোট পণ্য ব্যবসার ৩২ শতাংশ ছিল ইউরোপের সঙ্গে।
গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে ‘নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সম্পূর্ণভাবে অতিরিক্ত এবং একেবারেই ব্যর্থ কৌশল’ আখ্যা দিয়ে ল্যামি বলেন, ‘আমরা এখন এই সংঘাতের এক অন্ধকার নতুন পর্বে প্রবেশ করছি।’
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বক্তব্য চলাকালে পেছন থেকে ‘গণহত্যা’ বলে চিৎকার শোনা যায়।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ল্যামি বলেন, ‘এই সরকার গাজার মানুষদের ঘরছাড়া করে দক্ষিণের এক কোণে ঠেলে দিতে চায় এবং প্রয়োজনীয় ত্রাণের সামান্য অংশ দিতে চায়।’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্যকে ‘ইসরায়েলবিরোধী ভাবনার আবেশে আক্রান্ত’ বলে অভিহিত করে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের সরকার যদি ঘরোয়া রাজনৈতিক লাভের জন্য নিজ দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, তবে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।’
তিনি আরও বলেন, পশ্চিম তীরে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তা অযৌক্তিক ও দুঃখজনক। তার ভাষায়, ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হয়েছে ৭৭ বছর আগে। বাহ্যিক চাপ কখনোই ইসরায়েলকে তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার পথ থেকে সরাতে পারবে না।
পার্লামেন্টে ল্যামি আরও জানান, ইসরায়েলি মন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ বলেছেন, গাজাকে ‘পরিষ্কার’ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তর করতে হবে।
ল্যামি বলেন, এটি চরমপন্থা। এটি বিপজ্জনক, বিকৃত ও ঘৃণ্য।
তিনি জানান, ব্রিটেনে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত টজিপি হোটোভেলিকে তলব করে জানানো হয়েছে, গাজায় সাম্প্রতিক হামলা বন্ধ করতে হবে।
ল্যামি স্বীকার করেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল এক জঘন্য হামলার শিকার হয়েছে এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।
তবে তিনি বলেন, গাজায় সামরিক অভিযান নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, মাত্রাতিরিক্ত ও সম্পূর্ণ ব্যর্থ পদক্ষেপ… এটি জিম্মিদের মুক্ত করার পথ হতে পারে না।
ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস ত্রাণ সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং তাই অভিযান চালানো জরুরি।
কিন্তু ল্যামি বলেন, ত্রাণ আটকে দিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে জিম্মিদের মুক্তি সম্ভব নয়।
তিনি জানান, গাজার মানুষ এখন দুর্ভিক্ষ, গৃহহীনতা ও বোমাবর্ষণের মাঝে নতুন করে বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এবং প্রায় ৬০০ দিন ধরে বন্দী থাকা জিম্মিরা আরও ঝুঁকির মুখে।
তিনি বলেন, তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে এবং শুধু না খেয়ে মরার মতোই পরিমাণে ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে। গতকাল মাত্র ৫টি ট্রাক গাজায় ঢুকেছে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, লাখো ফিলিস্তিনির মাথার ওপর দুর্ভিক্ষের ছায়া।
ল্যামি বলেন, ইসরায়েল এখন তার বন্ধুবান্ধব ও অংশীদারদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, যা ইসরায়েলি জনগণের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি একজন আজীবন ইসরায়েল-সমর্থক হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
তবে অনেক লেবার ও টোরি এমপি ল্যামির বক্তব্যকে যথেষ্ট বলে মনে করেননি। তারা ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা, আগামী মাসে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি, এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পূর্ণ বাণিজ্য বন্ধের দাবিও জানান।
ল্যামি জানান, এ বিষয়ে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং তা মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে।
তিনজন ইসরায়েলি দখলদার বসতি স্থাপনকারী এবং পশ্চিম তীরের চারটি প্রতিষ্ঠান ও ফার্মের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন দানিলা ওয়েইস, যিনি সম্প্রতি লুই থেরুর ডকুমেন্টারিতে অংশ নিয়েছেন। তার বক্তব্য, এই নিষেধাজ্ঞা শিশুসুলভ, যা তার বা দখলদারদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
তবে এখনো ইসরায়েলের দুই মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী স্মোটরিচ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেন-গভিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি, যদিও তাদের বক্তব্য পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।
ল্যামি বলেন, জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৯ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক প্রস্তুত রেখেছে। নেতানিয়াহুকে এখনই অবরোধ তুলে নিতে হবে।
এছাড়া আরও চারটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। লেবার নেতা কেয়ার স্টারমারও বলেন, আমরা গাজার মানুষকে অনাহারে মরতে দিতে পারি না।
ওএফ