তালেবানের ‘সোহবত’ পেতে মরিয়া ভারত, পিছিয়ে নেই পাকিস্তান-ইরান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১৭:৫৯

আফগানিস্তানের সাথে যোগাযোগে আগ্রহ দেখাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো /ছবি : সংগৃহীত
যে দেশের সরকারকে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, সেই আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি সম্প্রতি ব্যস্ত সময় পার করছেন।
গেল কয়েক দিনে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন আবার ইরান ও চীন সফর করেছেন। বেইজিংয়ে তিনি আবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বুধবার তিনি পাকিস্তান ও চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক আলোচনাতেও অংশ নেন।
এই কূটনৈতিক তৎপরতা এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন তালেবান ঐতিহাসিকভাবে এই দেশগুলোর সঙ্গে টানাপোড়েনপূর্ণ সম্পর্কে জড়িত। আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গেও তাদের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক। দুই দেশের পারস্পরিক আস্থার সংকট একেবারে তলানিতে।
জাতিসংঘ কিংবা এর কোনো সদস্য রাষ্ট্র তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, বিশ্বমঞ্চে তালেবান এখন আর একঘরে নয়।
তাহলে কেন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি এড়িয়ে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে তালেবান সরকারের সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের আঞ্চলিক কূটনৈতিক তৎপরতাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এই তিন প্রতিবেশী দেশ তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী বলে জানানো হয়েছে।
গেল কয়েক সপ্তাহে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা বলেছেন, তার একটি সময়ক্রম নিচে তুলে ধরা হলো-
১৯ এপ্রিল : পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে কাবুলে যান। তিনি মুত্তাকি ও অন্যান্য আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে পাকিস্তান থেকে আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে চলমান উত্তেজনা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
৬ মে : ইসহাক দার ও মুত্তাকির মধ্যে আবারো ফোনে কথা হয়। এর পরের দিন পাকিস্তান আক্রমণ ভারত। যার জেরে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে চারদিন ধরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলে।
১৫ মে : ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি পাহেলগাম হামলার নিন্দা করার জন্য তালেবান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
১৭ মে : মুত্তাকি ইরানের রাজধানী তেহরানে পৌঁছান। তিনি সেখানে ‘তেহরান ডায়ালগ ফোরামে’ অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ও প্রেসিডেন্ট মাসউদ পাজেশকিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আজকের আফগানিস্তানের বাস্তবতা তালেবান। কারণ তারা দেশের সমগ্র ভূখণ্ড ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে
সুহাইল শাহীন
তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান, দোহা (কাতার)
২১ মে : বেইজিং সফরে যান মুত্তাকি। সেখানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যার লক্ষ্য ছিল তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো।
এ প্রসঙ্গে কাতারের দোহায় অবস্থিত তালেবানের রাজনৈতিক দপ্তরের প্রধান সুহাইল শাহীন বলেন, ‘আজকের আফগানিস্তানের বাস্তবতা তালেবান। কারণ তারা দেশের ভূখণ্ড ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে।’
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলো এই বাস্তবতা জানে বলেই তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ রাখে, যা আমার দৃষ্টিতে একটি বাস্তববাদী ও যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, যোগাযোগ ও সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাই তালেবান সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়।’
তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে মরিয়া ভারত
যদিও এটা একসময় অকল্পনীয় ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে ভারত সরকার এই গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তখন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতিও দেয়নি। ওই সময় তালেবানকে শুধু পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ওই সময় সোভিয়েত-সমর্থিত আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর সরকারকে সমর্থন করেছিল ভারত। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর কাবুলে নিজের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। ভারতের দৃষ্টিতে তালেবান ছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ‘প্রক্সি’, যারা মস্কোর বিরুদ্ধে মুজাহিদদের সমর্থন দিয়েছিল।
পরবর্তীতে ভারত তালেবানবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সমর্থন দেয়।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন অভিযানে তালেবান উৎখাত হওয়ার পর ভারত আবার কাবুলে দূতাবাস চালু করে। মার্কিন সমর্থিত আফগানিস্তানে একটি প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হয়ে ওঠে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, তারা আফগানিস্তানে অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানিসম্পদ খাতে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে।
তবে সেই সময় বারবার ভারতীয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো তালেবান এবং তাদের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর ভয়াবহ হামলার শিকার হয়।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান পুনরায় ক্ষমতা দখলের পর ভারত কাবুলে তার দূতাবাস খালি করে ফেলে। এবারও তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় ভারত। তবে, এই তালেবান শাসন আগের শাসনামলের মতো নয়। এবার ভারত গোপনে তালেবানদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ তৈরি করে এবং ধীরে ধীরে তা প্রকাশ্যে আনে।
বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে যুক্তি ছিল স্পষ্ট। ভারত তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে পাকিস্তানের কাছে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তুলে দিয়েছিল।
২০২২ সালের জুনে, তালেবান ক্ষমতায় ফেরার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, ভারত আবার কাবুলে দূতাবাস খোলে। সেখানে তারা ‘প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের’ একটি দল মোতায়েন করে। এরপর ২০২৪ সালের নভেম্বরে তালেবান মুম্বাইয়ের আফগান কনস্যুলেটে একজন ভারপ্রাপ্ত কনসাল নিয়োগ দেয়।
এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দুবাইয়ে সাক্ষাৎ করেন। এটি ছিল ভারত-তালেবান সম্পর্কের সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের প্রকাশ্য বৈঠক।
এমনকি তালেবানদের আদর্শিক শক্তির উৎস দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাও ভারতে। এমন পারস্পারিক সম্পর্ককে মুছে ফেলা যায় না। বরং বাস্তব ও কার্যকর উপায়ে সেটা মোকাবিলা করতে হবে
কবীর তানেজা
উপপরিচালক, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, নয়াদিল্লি
নয়া দিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক কবীর তানেজা বলেন, ‘কাবুলে যেই রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হোক না কেন, সেটিকে উপেক্ষা করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।’
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘কারও কাছে হয়তো তালেবান একটি আদর্শ পরিস্থিতি নয়, কিন্তু আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতের বহু দশকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুরোপুরি মুছে যায়নি।’
তানেজা বলেন, ‘এমনকি তালেবানদের আদর্শিক ভিত্তি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাও ভারতে অবস্থিত। তাই এই দেশ ও এর সামাজিক-ধর্মীয় বাস্তবতার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অস্বীকার করা যাবে না। বরং বাস্তব ও কার্যকর উপায়ে মোকাবিলা করতেই হবে।’
পাকিস্তানের হিসাবনিকাশ কী?
১৯৯৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তালেবানের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল পাকিস্তান। কিন্তু তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই পক্ষের সম্পর্ক দ্রুত অবনতি ঘটে।
২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ বেড়েছে বলে দাবি ইসলামাবাদের। এসব হামলার জন্য পাকিস্তান দায়ী করছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি)। ইসলামাবাদের দাবি অনুযায়ী, এই গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ভেতর থেকে কার্যক্রম পরিচালান করছে। আর তালেবান সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। যদিও তালেবান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
২০০৭ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলাকালে আবির্ভূত টিটিপি দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও আফগান তালেবান ও টিটিপি আলাদা গোষ্ঠী। তবুও তাদের আদর্শগত মিল রয়েছে বলে মনে করা হয়।
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের পরিচালক রাবিয়া আখতার বলছেন, ‘ইসহাক দারের কাবুল সফর ও আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে তার যোগাযোগকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের কোনো মৌলিক পরিবর্তন নয়। বরং এটি কৌশলগত সমঝোতা হিসেবেই দেখা উচিত।’
আখতার বলেন, ‘সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংকটকালে ইসলামাবাদ আশঙ্কা করেছে যে, আফগানিস্তান তার ভূখণ্ড পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভারতকে দিতে পারে। ফলে পশ্চিম সীমান্ত নিরাপদ করার বিষয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগ বাড়ে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো অন্যতম সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ এসব শরণার্থীদের অনেকেই জন্ম থেকেই পাকিস্তানে রয়েছেন। সংঘাতের কারণে সীমান্ত প্রায়ই বন্ধ রাখায় বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটছে। যা দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনার অন্যতম উৎস।’
রাবিয়া আখতারের মতে, ‘বিশেষ করে শরণার্থী ইস্যুটি ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেখানে পাকিস্তান অনিবন্ধিত আফগানদের ফেরত পাঠানোর ওপর জোর দিচ্ছে, কাবুল সেগুলোকে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।’
তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন বলেন, ‘কাবুল ইসলামাবাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, কিন্তু সে সম্পর্ক পারস্পরিক হতে হবে। দোষারোপের রাজনীতি কারও জন্যই ভালো নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান লাগোয়া সীমান্তে আফগানিস্তান চেকপোস্ট স্থাপন শুরু করেছে, যাতে কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে না পারে। তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব, আমাদের নয়।’
চীন জানায়, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় কাবুল ও ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। শিগগিরই উভয় দেশ দূত পাঠাবে।
তবু রাবিয়া আখতার মনে করেন, বিশেষ করে টিটিপি ঘাঁটি নিয়ে যে ‘মূল অবিশ্বাস’ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে রয়েছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয়।
তিনি বলেন, ‘এই পরিবর্তনকে পাকিস্তানের বৃহত্তর সংকট মোকাবিলা কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা উচিত।’
ইরান তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে কী চায়?
ভারতের মতোই, তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় এলে তেহরানও তাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরীফে তালেবান যোদ্ধাদের হাতে ইরানি কূটনীতিকদের হত্যার পর থেকে তারা নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন দেয়।
আগে ইরান ও ভারত মনে করত যে তালেবান পাকিস্তানের প্রভাবাধীন। এখন তারা বুঝেছে এটা ঠিক নয়। তারা একটি নতুন বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারিক কৌশল গ্রহণ করেছে, যা সবার জন্যই ভালো।
সুহাইল শাহীন
তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান, দোহা (কাতার)
ওই ঘটনার পর ইরান তার পূর্ব সীমান্তে হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে, ৯/১১-এর পর এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ইরান। তারা নীরবে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ চালায়। ওই সময় কিছু সীমিত সহায়তা দিয়ে মার্কিন প্রভাব মোকাবিলা ও নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে।
প্রায় চার বছর আগে তালেবান আবার আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর, নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যিক বিভিন্ন ইস্যুতে কাবুলের শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ইরান আবারও আগ্রহ দেখিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
এসব বিষয়ে দোহায় তালেবানের কার্যালয়ের প্রধান সুহাইল শাহীন বলেন, ‘আগে ইরান ও ভারত মনে করত যে তালেবান পাকিস্তানের প্রভাবাধীন। এখন তারা বুঝেছে এটা বাস্তব নয়। এই বাস্তবতা বিবেচনায় তারা একটি নতুন বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারিক কৌশল গ্রহণ করেছে, যা সবার জন্যই ভালো।’
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস বলেন, ‘মুত্তাকি ও ইরানের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ আসন্ন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ইঙ্গিত দেয় না।’
তবে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা-ভিত্তিক কিছু বিবেচনা ইরানকে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে বাধ্য করেছে। কারণ আফগানিস্তানে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে।’
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘নিরাপত্তার দিক থেকে, তেহরান আইএসআইএলের (আইএস) স্থানীয় শাখাকে ঠেকাতে মিত্র খুঁজছে। পাশাপাশি ইরান আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণেও আগ্রহী। এখন আফগানিস্তান ইরানের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার।’
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কেরমান শহরে জোড়া আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৯৪ জন নিহত হয়। যা সাম্প্রতিক দশকে ইরানের অন্যতম ভয়াবহ হামলা হিসেবে বিবেচিত। আফগানিস্তানভিত্তিক আইএসআইএলের শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি) এই হামলার দায় স্বীকার করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইএসকেপি তালেবানের শাসনব্যবস্থার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। তারা আফগানিস্তানজুড়ে একাধিক বোমা হামলা চালিয়েছে।
বাহিস বলেন, ‘ইরানের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশটিতে বসবাসরত প্রায় ৭.৮ লাখ আফগান শরণার্থীর সমস্যার সমাধান করা। পাশাপাশি হেলমান্দ নদীর পানি বিষয়ে সমাধান খোঁজা।’
২০২৩ সালের মে মাসে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। তখন সীমান্ত সংঘর্ষে দুজন ইরানি সীমান্তরক্ষী ও একজন তালেবান যোদ্ধা নিহত হন।
এই সহিংসতা ঘটে তখন, যখন প্রয়াত ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি তালেবানকে ১৯৭৩ সালের পানি বণ্টন চুক্তি লঙ্ঘন করে হেলমান্দ নদী থেকে ইরানের পূর্বাঞ্চলে পানি প্রবাহ বন্ধ না করার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। যদিও তালেবান ওই অভিযোগ অস্বীকার করে।
ওএফ