জিম্মি মুক্তির প্রতিশ্রুতি
মার্কিন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনায় যেসব পরিবর্তন চাইল হামাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৮:৩৭

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের জবাবে হামাস বলেছে, তারা ১০ জন জীবিত ও ১৮ জন মৃত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত। তবে এর বিনিময়ে একটি গ্রহণযোগ্য পরিমাণে ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে তারা প্রস্তাবে কিছু সংশোধন চেয়েছে।
এই প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট কোনো প্রত্যাখ্যান বা সরাসরি গ্রহণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী ইসরায়েল যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে, সেটির জবাবে হামাস এক ধরনের পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে।
হামাস তাদের আগের দাবিগুলো আবারও জানিয়েছে যে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং সেখানে অব্যাহতভাবে মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করার গ্যারান্টি তারা চায়। যদিও দাবিগুলো বর্তমান প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত নয়।
হামাস জানিয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফের খসড়া প্রস্তাবের জবাব দিয়েছে।
উইটকফ এক বিবৃতিতে বলেন, আমি হামাসের পক্ষ থেকে প্রস্তাবের জবাব পেয়েছি। এটি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য যা আমাদের পেছনে ঠেলে দেয়। হামাসের উচিত আমাদের দেওয়া কাঠামোগত প্রস্তাব গ্রহণ করা ও আলোচনায় অগ্রসর হওয়া। কেবল এই পথেই আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছাতে পারি।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকেও বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েল জিম্মিদের মুক্তির লক্ষ্যে উইটকফের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, কিন্তু হামাস এখনো তাদের অস্বীকৃতির অবস্থানে রয়েছে।
আর হামাস একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চায়। হামাসের দাবি, গাজায় মানবিক সহায়তার ধারাবাহিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর বিনিময়ে তারা ১০ জন জীবিত ও ১৮ জন মৃত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।
তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হামাস এখন সবচেয়ে জটিল ও কঠিন অবস্থানে রয়েছে। ২২ লাখ মানুষের চাপ, যারা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। মধ্যস্থতাকারীদের চাপের মুখে হামাস এমন প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না যা আগের প্রত্যাখ্যাত প্রস্তাবগুলোর চেয়েও কম উদার। সর্বশেষ মার্চ মাসে তারা এমনই একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তখন হামাসের শীর্ষ নেতা ও প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এমন কোনো চুক্তি মানব না যা স্থায়ী যুদ্ধের অবসান নিশ্চিত করে না।
তবে এখন পরিস্থিতি এমন, হামাস সরাসরি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যানও করতে পারছে না, কারণ তারা জানে ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযান আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর হামাসের পক্ষে এই আগ্রাসন প্রতিহত করা বা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামরিক সক্ষমতাও নেই।
এই দুই বাস্তবতার মধ্যে পড়ে হামাস কার্যত কোনো সরাসরি জবাব না দিয়ে একটি নতুন পাল্টা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রস্তাবের পূর্ণ বিবরণ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। তবে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো হলো:
* ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি
* প্রথম সপ্তাহে ২৮ জন ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তি (জীবিত ও মৃত)
* স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত হলে আরও ৩০ জন জিম্মির মুক্তি
* ১,২৩৬ ফিলিস্তিনি বন্দি ও ১৮০ মৃত ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত দেওয়া
* জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো
এই প্রস্তাবগুলো ইসরায়েল গ্রহণ করতে পারে এমনভাবেই হোয়াইট হাউস এগুলো তৈরি করেছে। আর ইসরায়েলের সম্মতি নিয়েই প্রস্তাবটি হামাসের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তবে হামাস যে পরিবর্তন চায়, তা নিয়ে আলোচনায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রাজি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি জিম্মিদের মুক্তির জন্য সাময়িক যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েল বরাবরই যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার অধিকার রেখে দিয়েছে। যা হামাসের মূল দাবি, যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে —তার পরিপন্থী।
নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে যখন হামাস অস্ত্র নামিয়ে রাখবে, গাজায় আর সরকার পরিচালনা করবে না। আর এই নেতারা অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবে।
সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ আরও কঠোর ভাষায় বলেন, হামাসের ঘাতকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ‘উইটকফ চুক্তি’ মেনে নিয়ে জিম্মিদের মুক্তি দেবে, নাকি নিশ্চিহ্ন হবে।
এদিকে, হামাসের নেতা বাসেম নাইম বিবিসিকে বলেছেন, গত সপ্তাহে আমরা উইটকফের সঙ্গে একটি প্রস্তাবে একমত হয়েছিলাম, যা তিনি আলোচনার জন্য গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া সেই সব শর্তই অস্বীকার করেছে যেগুলোতে আমরা সম্মত হয়েছিলাম।
তিনি বলেন, প্রতিবার কেন ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়াই আলোচনার ভিত্তি হবে? এটি মধ্যস্থতার নিরপেক্ষতা নষ্ট করে এবং একপাক্ষিক পক্ষপাতের পরিচয় বহন করে।
এদিকে শনিবার হামাস-চালিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ৬০ জন নিহত ও ২৮৪ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর গাজা অঞ্চলের হাসপাতালে তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি, কারণ সেখানে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের সীমান্ত পেরিয়ে চালানো হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, এ পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৫৪ হাজার ৩৮১ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৮ মার্চের পর থেকে ইসরায়েলি অভিযানে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ১১৭ জন।
ওএফ