৬০০ দিন ছাড়াল গাজা যুদ্ধ
হামাসের ফাঁদে ধরাশায়ী ইসরায়েল

সাইদ মার্কোস তেনোরিও
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১৪:১৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ইসরায়েল ২৭৫ টন বোমা ফেলেছে /ছবি : সংগৃহীত
গাজায় ৬০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। বিমান ও স্থল হামলা চালানোর পরেও নেতানিয়াহুর নাৎসি-জায়োনিস্ট সরকার তাদের ঘোষিত তিনটি লক্ষ্যই অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নগুলো সামনে আসছে, সেগুলো হলো— ‘ইসরায়েল এখনো হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি কেন?’, ‘কেন এমনটা ঘটছে?’, ‘হামাস এতটা সাহসী কেন আর কেনই বা অদম্য মনে হচ্ছে?’
এসব প্রশ্নে বোঝা যায়, অনেকেই এখনো উপলব্ধি করতে পারছেন না যে হামাস একটি দৃঢ় প্রতিপক্ষ, আর ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ভূমিতে টিকে থাকার ও দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য সংকল্পে অবিচল।
গাজায় অবকাঠামো ধ্বংস ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ নেতাদের হত্যার পরেও ইসরায়েল সেখানে বিজয় অর্জন করতে পারেনি। হামাস এখনো টিকে আছে এবং লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জায়নিস্ট বাহিনীকে বারবার নিজেদের সীমানায় ফিরে যেতে বাধ্য করছে।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ইসরায়েলি ‘যুদ্ধমেশিন’ এখন পর্যন্ত গাজায় ব্যর্থ হয়েছে। তারা এক ভয়াবহ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধ তাদের নেতৃত্বকে দুর্বল করেছে। ইসরায়েলি সমাজে বিভাজন তৈরি করেছে। সেনাবাহিনীতে ক্লান্তি ও মানসিক ভাঙন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। হাজার হাজার সৈনিক মানসিক সমস্যায় সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন; বেড়েছে আত্মহত্যার হারও। ইসরায়েল হয়তো প্রতিটি সামরিক সংঘর্ষে জয়লাভ করছে, কিন্তু যুদ্ধে নিঃসন্দেহে হারার পথে।
গাজা নিয়ে নেতানিয়াহুর লক্ষ্য হলো, দমন-পীড়ন, বোমা বর্ষণ ও দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ২১ লাখ ফিলিস্তিনিকে শেষ করে ফেলা। তিনি প্রতিদিন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন নির্মম নিষ্ঠুরতায়। অথচ পশ্চিমা শক্তিগুলো এখনো এর বিরুদ্ধে কেবল বক্তব্য রেখেই দায় সারছে। তারা এখনো গণহত্যা থামাতে কিংবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
গাজা খালি করার ইসরায়েলি পরিকল্পনা প্রতিদিন ব্যর্থ হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী ভাষ্য সত্ত্বেও, যারা মিথ্যা আশ্বাসে গাজা ছেড়ে গিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর তারা আবার ফিরছেন। যদিও তাদের ঘরবাড়ি কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এই যুদ্ধে, ইসরায়েল এতটাই ভয়াবহ মাত্রায় শক্তি প্রয়োগ করেছে যে তা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত শক্তিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ১৯ বছরব্যাপী ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫ টন বিস্ফোরক ফেলেছিল, সেখানে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ইসরায়েল ফেলেছে ২৭৫ টন, যা ১৮ গুণ বেশি।
ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার অটল সংকল্প এবং বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জনমতই শেষ পর্যন্ত তাদের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের পথে এগিয়ে নেবে। এখন এই সমর্থন শুধু বামপন্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; মধ্য ও ডানপন্থী মহলেও তা ছড়িয়ে পড়ছে। ‘গণহত্যার বিরুদ্ধে’ প্রতিবাদকে ‘বিরোধিতা’ বলে অ্যান্টিসেমিটিজমের লেবেল দেওয়ার কৌশল এখন আর আগের মতো কাজ করছে না।
ফিলিস্তিনকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, ইসরায়েল এখন পুরো পৃথিবীকে ফিলিস্তিনে পরিণত করে ফেলেছে। বিশ্বের বড় বড় শহরের রাস্তায় কোটি কোটি মানুষ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করেছে। গাজাকে অবরুদ্ধ করতে গিয়ে, জায়নবাদ নিজেকেই অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। জায়নবাদ এখন এক চূড়ান্ত অবনতির মুখোমুখি। ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারিও জায়নবাদ অবসানের অনুমান করছেন।
গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই গণহত্যায় আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে। স্কুল-হাসপাতালের মতো মানবিক স্থানগুলো বোমা বর্ষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। তাও কোনোভাবেই ইসরায়েলকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনে সফল করতে পারেনি, বিশেষত ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে।
ইসরায়েলের একমাত্র অর্জন আজ অবধি যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, শিশু ও নারীদের গণহারে হত্যা, অবকাঠামোর ধ্বংস এবং গাজায় জীবনের প্রতিটি স্তরকে নিশ্চিহ্ন করা। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি জনগণ বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করছে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দেশপ্রেম, মাতৃভূমির প্রতি টান ও প্রতিরোধের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের অনন্য চিত্র।
লেখক : ব্রাজিল-প্যালেস্টাইন ইনস্টিটিউটের (ইব্রাস্পাল) প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট