ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের একজন ছাড়া সবাই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। বিমানে থাকা ২৪২ জনের মধ্যে বিজেপির প্রবীণ নেতা ও গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানিসহ ২৪১ জনই নিহত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের এক মিনিটের মাথায় বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বিমানটি আহমেদাবাদের মেঘানীনগর এলাকায় একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায়।

বিমানে মোট ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু ছিলেন। এদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ ও একজন কানাডিয়ান নাগরিক বলে জানায় এয়ার ইন্ডিয়া।

গুজরাট বিজেপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিআর পাটিল বলেন, ‘আমাদের নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানি লন্ডনে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনিও এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এটা আমাদের দলের জন্য বিশাল ক্ষতি। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’

বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী রাম মোহন নাইডু নিশ্চিত করেছেন যে বিজয় রুপানি এই বিমানে ছিলেন। 

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে। কেন এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের নেতা বিজয় রুপানিসহ আরও অনেক নাগরিক এতে প্রাণ হারিয়েছেন।’

বিজয় রুপানি ২০১৬ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। করোনা-পরবর্তী সময়ের পুনরুদ্ধারপর্বে তিনি গুজরাটকে নেতৃত্ব দেন। তার সময়ে গুজরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি ২০২০ চালু হয় এবং আদিবাসী উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পরে ২০২১ সালে নির্বাচনের আগে দলের কৌশলগত রদবদলের অংশ হিসেবে তিনি পদত্যাগ করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হন ভূপেন্দ্র পটেল।

রাজনীতিতে রুপানির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে রাজকোটে একজন পৌর কর্পোরেটর হিসেবে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি দলের অন্যতম আস্থাভাজন ও পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে গেছেন।

সূত্র মতে, বিমানটির সিট চার্ট অনুযায়ী বিজয় রুপানি ২ডি সিটে বসা ছিলেন এবং তিনি লন্ডনে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন।

এদিকে, উদ্ধারকারী কর্মীরা জানিয়েছেন, বিমানটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এটি দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ও উন্নত প্রযুক্তির যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে পরিচিত। এই মডেলের বিমানে এর আগে কোনও মারাত্মক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, ‘আহমেদাবাদের দুর্ঘটনা আমাদের স্তব্ধ ও শোকাহত করেছে। এটি ভাষায় প্রকাশের ঊর্ধ্বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই দুঃখের মুহূর্তে আমি ক্ষতিগ্রস্ত সকলের পাশে আছি। আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, যারা উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে।’

২০৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২০৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আহমেদাবাদের পুলিশ প্রধান জিএস মালিক।

তবে, তারা সবাই বিমানের যাত্রী নাকি তাদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিলেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ৪১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার তথ্যও জানিয়েছেন তিনি।

তবে আশ্চর্যজনক ভাবে বিমানের এক যাত্রীকে জীবিত পাওয়া গেছে। ওই ব্যক্তি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পুলিশ কমিশনার বলেছেন, বিশ্বাস কুমার রমেশ নামে ওই ব্রিটিশ নাগরিক বিমানটির ১১এ নম্বর আসনে বসেছিলেন।

এদিকে আহমেদাবাদে মরদেহগুলো শনাক্ত করার প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে।

গুজরাট স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব ধনঞ্জয় দ্বিবেদী জানিয়েছেন, যেসব যাত্রীর দেহ শনাক্ত করার অবস্থায় নেই, তাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে, এমন আত্মীয় অর্থাৎ বাবা-মা অথবা সন্তানের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে সিভিল হাসপাতালে।

নিহতের প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি রূপি করে ক্ষতিপূরণ
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক যাত্রীর পরিবারকে এক কোটি রূপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার মালিক প্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপ। আহতদের চিকিৎসার খরচও বহন করবে প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া, বিমান আছড়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মেডিকেল হোস্টেল পুননির্মাণে সহায়তা করবে তারা।

সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে টাটা গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা কতটা শোকাহত তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

তদন্তে আসছে ব্রিটিশ ও মার্কিন দল
ভারতে বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে সহায়তা করতে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি তদন্ত দল। ভারতের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ড এ তথ্য জানিয়েছে।

এছাড়া, একটি ব্রিটিশ দলকেও তদন্তে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থা।

বিমানবন্দর আবার চালু
ভারতের আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইকের উদ্দেশে রওনা করা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পর সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আবার চালু করা হয়েছে।

সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এক্স-এর এক পোস্টে তারা জানায়, ‘আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে সব অপারেশন পুনরায় চালু হয়েছে।’

সঙ্গে যাত্রীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, সবাই যেন নিজ নিজ এয়ারলাইনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং বিমানবন্দরের অফিশিয়াল আপডেটের দিকে নজর রাখেন।

যা বলল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনাকে অত্যন্ত মর্মান্তিক হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল।

তিনি আজ তার সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।’

তবে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শোক
ভারতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। বৃটেন, রাশিয়া, ফ্রান্সের পক্ষ থেকে বিমানের যাত্রী ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।

উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক্সে এক পোস্টে বিমান আরোহীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার। 

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও শোক জানিয়ে বলেন, আমরা ভারতের পাশে আছি।

শোক প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের উদ্ধৃতি দিয়ে সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে দুর্ঘটনার মর্মান্তিক পরিণতির জন্য আমার গভীর সমবেদনা গ্রহণ করুন।

বিমান দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শোক প্রকাশ করেছেন জেনারেল সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পারওয়ার।

ওএফ