Logo

আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের ছায়া

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১৯:৫৬

মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের ছায়া

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা ক্রমেই ঘনিভূত হচ্ছে। সরাসরি সংঘর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুটি শক্তিধর রাষ্ট্র। একদিকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, অন্যদিকে উচ্চমাত্রার বিমান অভিযানের মাধ্যমে দুই পক্ষ একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ না হলে তেহরান জ্বলবে।

শুরুতে মিত্র, এখন চরম শত্রু
১৯৭৯ সালের আগে ইরান ছিল ইসরায়েলের একমাত্র আঞ্চলিক মিত্র। পারস্পরিক বাণিজ্য ছিল, সামরিক সহযোগিতাও ছিল দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের পর দৃশ্যপট বদলে যায়।

খোমেনির নেতৃত্বে ইরান ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে ‘অবৈধ’ বলল। ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিল। এরপর থেকে ইরান পরিণত হলো হামাস, হিজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদের মতো প্রতিরোধ গোষ্ঠীর অর্থ ও অস্ত্রের উৎসে।

ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরান এখন শুধু শত্রু নয় আস্তিত্বের হুমকি।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয় ১২০০ জন। গাজায় চলমান ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

এই ঘটনার পর ইরান শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে শুরু করে। হিজবুল্লাহ রকেট ছোড়ে, হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলগামী জাহাজে হামলা করে। সিরিয়া ও ইরাক থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়া হয়।

সর্বশেষ, শুক্রবার (১৩ জুন) রাত থেকে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানের ভেতরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এতে রাজধানী তেহরানের দক্ষিণাঞ্চলে একটি সামরিক ঘাঁটি, ইসফাহানের পারমাণবিক গবেষণাগার ও খুজেস্তান অঞ্চলে রেভলিউশনারি গার্ডের অস্ত্রগার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ইরান বলছে, এসব হামলায় অন্তত ৭৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৩০ জন আহত। নিহত হয়েছেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাসহ অন্তত ৯ জন পরমাণুবিজ্ঞানী।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল রামেজানি বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা এখন থেকে সরাসরি প্রতিশোধে যাব। তেলআবিব ও হাইফা আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য। 

ইতোমধ্যে ইরান ২০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এতে তেলআবিবসহ আশকেলন ও বির শেভা শহরে অন্তত ৩ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছে।

ইরান ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ৮৪ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। 

ইসরায়েল বারবার বলে আসছে, ইরানকে কোনো অবস্থাতেই পরমাণু বোমা তৈরির পর্যায়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সাম্প্রতিক হামলায় ইসফাহানের কাছে নাতাঞ্জ ও ফোর্দোর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র।

কে কার পক্ষে
যুক্তরাষ্ট্র : ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে পারস্য উপসাগরে দুটি রণতরী ও বিমানবাহী জাহাজ মোতায়েন করেছে। যুদ্ধ ঠেকাতে তৎপর থাকলেও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করছে।

চীন ও রাশিয়া: ইরানের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক অংশীদার হলেও তারা এখনো সরাসরি সমর্থন জানায়নি। তবে ইরানে হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে।

আরব বিশ্ব: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো দ্বিধান্বিত অবস্থানে রয়েছে। হামাসকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সমর্থন থাকলেও ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপে উদ্বিগ্ন।

অর্থনৈতিক প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৯ শতাংশের কাছাকাছি বেড়ে গেছে, যা কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। হামলা পাল্টা হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কাও রয়েছে।

শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে অপরিশোধিত ব্রেন্টের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬ ডলার ১৯ সেন্ট বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ ডলার ৫৫ সেন্টে, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। এর আগে ইসরায়েলি হামলার তাৎক্ষণিক ‘ধাক্কায়’ দাম উঠে যায় ৭৮ ডলার ৫০ সেন্টে, যা ছিল গত ২৭ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।

এতে বাংলাদেশসহ আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এছাড়া স্পট মার্কেটে স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৪১৯ ডলার ৬৯ সেন্টে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিউচার মার্কেটে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ। আউন্সপ্রতি মূল্য পৌঁছেছে ৩ হাজার ৪৩৯ ডলার ৯০ সেন্টে।

বাংলাদেশে প্রভাব
বাংলাদেশে এখনো সরকারিভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। হজ মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে সৌদি আকাশপথ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রবাসী আয়, আমদানি ব্যয় ও জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

কী হতে পারে পরবর্তী পদক্ষেপ?
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধ এখন আর কেবল ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব নয়; বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির বড় পুনর্গঠন ডেকে আনতে পারে। পরিস্থিতি অবনতি হলে সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এমনকি ইরাকও সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ এখন যুদ্ধ থামানোর শেষ সুযোগ। তবে ইসরায়েল বা ইরান কেউই আপাতত পিছু হটছে না। ফলে বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে কখন ঝড় নামে আর মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ রঙিন হয় আগুনের আলোয়।

এই সংঘর্ষের শেষ কোথায় তা এখনই বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত যে, এই যুদ্ধ শুধু দুই রাষ্ট্রের নয়, বরং গোটা অঞ্চল ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক গুরুতর হুমকি। এখনো যদি সংযম ও কূটনৈতিক উদ্যোগ কার্যকর না হয়, তবে তেহরান-তেলআবিব সংঘর্ষ হয়ে উঠতে পারে এই শতাব্দীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধগুলোর একটি।

ওএফ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর