Logo

আন্তর্জাতিক

ইরানে হামলার পেছনের হিসাব-নিকাশ কী?

Icon

আল-জাজিরা

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ২০:৪১

ইরানে হামলার পেছনের হিসাব-নিকাশ কী?

ইরানের সামরিক ও সরকারি বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে /ছবি : সংগৃহীত

ইসরায়েল বহু আগেই ইঙ্গিত দিয়ে ইরানে আক্রমণ শুরু করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, এই হামলা প্রয়োজন যত দিন থাকবে তত দিন চলবে।

শুক্রবার ভোরে শুরু হওয়া এই হামলাগুলো ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। এতে ইরানের সামরিক ও সরকারি বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে এবং কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীও রয়েছেন।

এই হামলা এমন এক সময়ে হলো, যখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছিল। অনেকের ধারণা, ইসরায়েলের এই আক্রমণের হুমকি আসলে ইরানের ওপর চাপ বাড়ানোর একটি যৌথ কৌশল হতে পারে।

মার্কিন সমর্থন ইসরায়েলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অস্ত্র সরবরাহ নয়, জাতিসংঘেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে একপ্রকার ঢাল হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব সংস্থাটিতে ইসরায়েলবিরোধী কোনো প্রস্তাব এলে প্রায়ই তা ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহুবার উঠেছে।

কিন্তু ইরানের মতো একটি আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত চালানো ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ইরানের মিত্রশক্তি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে আছে। একইসঙ্গে মার্কিন সেনারাও পুরো অঞ্চলে মোতায়েন, ফলে এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও জটিল।

তাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েল কেন এখন ইরানে হামলা করল?

ইরান কী আসলেই হুমকি?
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাদের প্রচলিত অস্ত্র বা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে না। বরং একটি বিশেষ সুবিধা তাদের আছে তা হলো পরমাণু অস্ত্র। যা এই অঞ্চলের আর কোনো দেশের নেই।

যদিও কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। তবুও সবাই জানে যে ইসরায়েলের কাছে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। এ অবস্থায় ইরান যদি পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে ইসরায়েলের এই একচেটিয়া সুবিধা শেষ হয়ে যাবে। এটাই ইসরায়েলের জন্য রেড লাইন।

বছরের পর বছর ধরে নেতানিয়াহু বলে এসেছেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। তবে ইরান বারবার বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে।

এই হামলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইরান খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারত—হয়তো এক বছরের মধ্যে, এমনকি কয়েক মাসেই। 

এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ইরানের কাছে কয়েক দিনের মধ্যেই ১৫টি পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা থাকবে।’

ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে অন্যরা কী বলছে?
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তির (এনপিটি) অধীনে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরান অবশ্য এই অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করেছে।

আইএইএ ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অসহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেছে। তবে সংস্থাটি কোথাও বলেনি যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে ইরান সম্মত হয়েছিল। তারা তাদের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করবে এবং আইএইএ নিয়মিত পরিদর্শনের সুযোগ পাবে। এর বিনিময়ে তারা নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাবে।

কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যান। এ সময় ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করেন।

এ বছরের মার্চে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড বলেন, ‘আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ২০০৩ সালে যে কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন, তা এখনো অনুমোদন দেননি।’

তাহলে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাল কেন?
নেতানিয়াহু আগেও ইরানকে আখ্যা দিয়েছেন ‘অক্টোপাসের মাথা’, যার ‘শুঁড়’ ছড়িয়ে রয়েছে হুথি, হিজবুল্লাহ থেকে শুরু করে হামাস পর্যন্ত। অর্থাৎ ইরান হচ্ছে সেই ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ নামে পরিচিত জোটের নেতা, যারা সবাই ইসরায়েলবিরোধী।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল হামাস ও হিজবুল্লাহকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। উভয় সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা নিহত হয়েছেন—যেমন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ, হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও ইসমাইল হানিয়া।

এই হামলাগুলোর পর প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া না আসায় ইসরায়েলের কট্টর নেতারা বলছেন, এখনই এক ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে ইরানসহ শত্রুদের দুর্বল করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দেওয়ার।

এমনকি কেউ কেউ মনে করছেন, ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের মতো সুযোগও এসেছে। যদিও তাতে একটি দীর্ঘ যুদ্ধের প্রয়োজন, যা ইসরায়েলের সামর্থ্যের বাইরে।

তবে গত বছরের পর থেকে ইসরায়েল, ইরান বা তাদের কোনো মিত্রের মধ্যে কোনো সরাসরি সংঘর্ষ হয়নি। কেবল হুমকি ছিল, ইসরায়েল আক্রমণ করলে পাল্টা জবাব আসতে পারে।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কি ভূমিকা রেখেছে?
ইসরায়েলের অনেকেই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। গাজায় যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়, যেখানে এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

সমালোচকদের মতে, নেতানিয়াহু ইরান বা গাজার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে নিজের জোট সরকার টিকিয়ে রাখছেন। অন্যথায় তাকে ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার ব্যর্থতা নিয়ে জবাবদিহি ও দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ডের ঝুঁকি নিতে হতো।

ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, ‘নেতানিয়াহুর কাছে বিদেশনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আলাদা কোনো বিষয় নয়। ইসরায়েলের ওপর কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি ছিল না। এটা অনিবার্য ছিল না। আইএইএর প্রতিবেদনে ইরানকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখানোর মতো কিছু ছিল না।’

হামলার পর ইসরায়েলের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহুর জোট কেবলমাত্র শেষ মুহূর্তে একটি আপসের মাধ্যমে সংসদ ভেঙে নির্বাচন আহ্বানের প্রস্তাব ঠেকাতে পেরেছে। এই আপস ছিল ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের সেনা ছাড়ের ইস্যুতে।

এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ায়ার লাপিদ ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ ইয়ায়ার গোলান পর্যন্ত এই হামলার প্রশংসা করেছেন।

তবে বামপন্থী এমপি ওফের কাসিফ বলেছেন, নেতানিয়াহুর এই সিদ্ধান্ত তার রাজনৈতিক চাপ এবং ‘রক্ত ও শক্তি ব্যবহার’–এ আসক্তি থেকে এসেছে। দুঃখজনক হলেও তিনি মনে করেন, বিরোধীদল এই হামলার সমর্থনে চলে গেছে।

ইসরায়েল কি আবার আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে?
কয়েকজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের মতে, হ্যাঁ—ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। গাজায় যুদ্ধ চলার সময়ই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহুবার আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার অভিযোগ উঠেছে।

ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অধ্যাপক মাইকেল বেকার আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘যে তথ্য প্রকাশ্যে আছে, তা অনুযায়ী ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই শক্তি ব্যবহার জাতিসংঘ সনদের আত্মরক্ষার অধিকার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।’

তিনি বলেন, ‘আত্মরক্ষার যুক্তি ব্যবহার করতে হলে ইসরায়েলকে প্রমাণ করতে হতো ইরান কোনো চলমান বা তাৎক্ষণিক হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু এর কোনো ইঙ্গিত নেই। এমনকি ইসরায়েল যা বলছে ইরান শিগগিরই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে তা-ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষার বৈধ কারণ নয়। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনা চলছিল।’

ওএফ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ইরান মধ্যপ্রাচ্য

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর