হোয়াইট হাউজে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান, কী বার্তা দিলেন ট্রাম্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ২০:৩৩

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার হোয়াইট হাউজে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। এটি মার্কিন ইতিহাসে প্রথম ঘটনা- যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন একজন সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানালেন যিনি দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান নন।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান অসিম মুনির পাঁচ দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।
এই বৈঠক বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই ট্রাম্প সাত বছর আগে পাকিস্তানকে ‘মিথ্যা ও প্রতারণা ছাড়া কিছু দেয় না’ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। দেশটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন।
আর তার পূর্বসূরি জো বাইডেন একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই তুলনায় এটি এক নাটকীয় কূটনৈতিক মোড়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই সম্পর্কের পুনর্গঠন কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। তা আরও মজবুত হয়েছে চলতি বছরের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষের সময়। তখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতার চেষ্টা চালায়।
তবে কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন, সম্পর্কের এই রূপান্তরকে প্রাতিষ্ঠানিক মার্কিন নীতির পরিবর্তে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে দেখা উচিত।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো মারভিন ওয়েইনবাউম আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা এমন একটি প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি, যারা প্রতি ঘণ্টায় তাদের অবস্থান বদলায়। এখানে কোনো প্রক্রিয়া নেই। এক মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই, আর পরের মুহূর্তেই অগ্রাধিকারের তালিকা পাল্টে যায়। এটি একটি রীতিমতো অস্থির ও ব্যক্তি-কেন্দ্রিক প্রশাসন, যা ঐতিহ্যগত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে খাপ খায় না।’
তবে অন্যরা বলছেন, মুনিরকে হোয়াইট হাউজে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
নিউইয়র্ক সিটির সিটি ইউনিভার্সিটির খ্যাতিমান অধ্যাপক রেজা আহমেদ রুমি বলেন, ‘ট্রাম্পের এই মধ্যাহ্নভোজ শুধু প্রচলিত প্রটোকল ভঙ্গ করেনি, বরং প্রটোকলের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, পাকিস্তান কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নজরে নেই, বরং নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যেও জায়গা করে নিচ্ছে—অন্তত এখনকার জন্য।’
আঞ্চলিক সংকটের মাঝেই সম্পর্ক পুনর্গঠন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় মধ্যপ্রাচ্যে চরম উত্তেজনার মধ্যে। গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ চালাচ্ছে। এর পাল্টা জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে।
ইসরায়েলি অভিযানগুলোতে ইরানি জেনারেল, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, পরমাণু স্থাপনা ও বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যাতে এখন পর্যন্ত ২০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, গত ছয় দিনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারিয়েছে ২০ জনের বেশি।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে এই অভিযানে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের রয়েছে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। যা এই উত্তেজনায় এক ভৌগোলিক বাস্তবতা হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
মুনিরের সঙ্গে বুধবারের মধ্যাহ্নভোজ শেষে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘অন্যদের চেয়ে পাকিস্তানিরা ইরানকে খুব ভালোভাবে চেনে।’ তবে তিনি যোগ করেন— ‘তারা খুব একটা খুশি নয়।’
তবে ট্রাম্প জানান, মুনিরকে আমন্ত্রণ জানানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল গত মে মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষ নিরসনে তার ভূমিকাকে ধন্যবাদ জানানো। এই সংঘাত এক পর্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ার ১৬০ কোটিরও বেশি মানুষের বাসস্থান অঞ্চলটিকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি তাকে (মুনিরকে) এখানে এনেছি এজন্য যে, আমি তাকে ধন্যবাদ দিতে চেয়েছি। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন বলে। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই, যিনি কয়েকদিন আগেই হোয়াইট হাউজে এসেছিলেন। আমরা এখন ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির ওপর কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই দুই ব্যক্তি এমন একটি যুদ্ধকে থামিয়ে দিয়েছেন, যেটা পারমাণবিক সংঘাতে পরিণত হতে পারত। পাকিস্তান ও ভারত—দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। আমি আজ তাকে (মুনিরকে) সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি।’
উল্লেখ্য, এই উত্তেজনা শুরু হয়েছিল এপ্রিল মাসে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হামলায় ২৬ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর। ভারত এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাকিস্তান অভিযোগ অস্বীকার করে একটি ‘বিশ্বস্ত, স্বাধীন ও স্বচ্ছ’ তদন্তের আহ্বান জানায়।
৭ মে ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা জবাবে তার বিমান বাহিনী দিয়ে কমপক্ষে ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি করে। ভারত তার ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করেনি।
এরপর তিন দিন উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করে এবং ১০ মে উভয়পক্ষই সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
বুধবার আবারও ট্রাম্প বলেন, ‘আমি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি। এই মানুষটি (মুনির) পাকিস্তানের দিক থেকে ব্যাপক প্রভাব রেখেছেন, মোদি ভারতের দিক থেকে এবং আরও অনেকে সহায়তা করেছেন।’
যদিও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে, ভারত জোর দিয়ে বলছে—এই যুদ্ধবিরতি ছিল সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সংলাপের ফল।
মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পকে ফোন করে ভারতীয় অবস্থান স্পষ্ট করেন এবং জানিয়ে দেন যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মধ্যস্থতা ছিল না।’
বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প ফোনে মোদির সঙ্গে কথা বলেন—যা আবারও এই বৈঠকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্পষ্ট করে তোলে।
ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পলিট্যাক্ট’-এর প্রধান কৌশলবিদ আরিফ আনসার বলেন, সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্মদক্ষতাই ট্রাম্পকে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে উৎসাহিত করেছে।
তিনি মনে করেন, ‘এটি দেখিয়েছে যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পাকিস্তান একটি বৃহৎ প্রতিপক্ষকে কৌশলে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম। এটাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে কৌশলগত স্বার্থে পুনঃসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী করে তুলেছে।’
আবারো গুরুত্ব পাওয়ার সুযোগ
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরই পাকিস্তান শীতল যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দুই দেশ যৌথভাবে মুজাহিদিনদের সহায়তা দেয়। তারা শেষ পর্যন্ত মস্কোকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করে।
পরবর্তী সময়ে ৯/১১-পরবর্তী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধেও’ যুক্তরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ায় পাকিস্তান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পাকিস্তানকে আর নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেননি।
বিশেষ করে ৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদের সামরিক সদর দপ্তরের কাছাকাছি জায়গায় নিহত হওয়ার পর এই আস্থা আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। একই সময়ে পাকিস্তান অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তির খাতে সহায়তার জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে থাকে।
তবে বিশ্লেষক মারভিন ওয়াইনবাম বলেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তান সেই সম্মান আবার পেতে শুরু করেছে। যেটি বাইডেন প্রশাসনের সময় অনুপস্থিত ছিল।
ওয়াইনবাম বলেন, ‘ট্রাম্প সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মনে হচ্ছে তিনি সেটা পেয়েও গেছেন।’
মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল ই. কুরিলা গত ১০ জুন কংগ্রেসে দেওয়া এক সাক্ষ্যে বলেন, এই সহযোগিতার ফলেই ২০২১ সালের কাবুল বিমানবন্দরের অ্যাবি গেট বোমা হামলার সন্দেহভাজন পরিকল্পনাকারীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
কুরিলা বলেন, ‘তারা (পাকিস্তান) এখনো সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা এ লড়াইয়ে তারা অসাধারণ এক অংশীদার।’
মধ্যপ্রাচ্য ও ইরানে মার্কিন সামরিক কার্যক্রম তদারককারী কুরিলা জানান, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির তাকে ফোন করে জানান যে—তারা ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএসকেপি বা দায়েশ-কে) এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন।
পাক-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে পাকিস্তান বাড়তি কিছু সুবিধাও দিচ্ছে বলে জানান ওয়াইনবাম। এর মধ্যে রয়েছে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব, দুর্লভ খনিজ পদার্থে বিনিয়োগের সুযোগ ও ক্রিপ্টোকারেন্সি খাতে অংশীদারিত্ব।
এই ‘রেয়ার আর্থ মিনারেল’ বা দুর্লভ খনিজ পদার্থগুলো প্রতিরক্ষা, রোবটিক্স ও ইলেকট্রনিক শিল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে পাকিস্তান এই খাতকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করছে। যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব।
সম্প্রতি পাকিস্তান একটি ‘ক্রিপ্টো কাউন্সিল’ গঠন করেছে এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতার বিষয়ে বৈঠক করেছে।
নিউইয়র্কের গবেষক রাজা আহমাদ রুমি এই মুনির-ট্রাম্প বৈঠককে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইছে পাকিস্তান যেন আঞ্চলিক অস্থিরতা হ্রাসে সহায়তা করে। তবে বিনিময়ে তারা বেশি কিছু দিতে চাইছে না। মুনিরের জন্য এটি আবারও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। একইসঙ্গে দেশের ভেতরে নিজের অবস্থান সংহত করার কৌশলগত মঞ্চও হতে পারে।’
লেনদেননির্ভর সম্পর্ক ও গণতান্ত্রিক মূল্য
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বেশিরভাগ সময়ই লেনদেননির্ভর, বিশেষ করে নিরাপত্তাখাতে। যখনই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্যপূরণে পাশে থেকেছে, তখনই ওয়াশিংটন থেকে বিনিয়োগ ও সামরিক অবকাঠামো গঠনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।
তবে এই সম্পর্ক বরাবরই অবিশ্বাসের ছায়ায় আচ্ছন্ন থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের ওপর দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলেছে। আবার পাকিস্তান দাবি করে, তারা যে মূল্য ও ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা কখনোই যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক ট্রাম্প-মুনির সম্পৃক্ততা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংহতির সূচনা না হয়ে আবারও স্বল্পস্থায়ী একটি পর্ব হয়ে যেতে পারে।
নিউইয়র্কভিত্তিক শিক্ষাবিদ রাজা আহমাদ রুমি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান-নীতির ইতিহাস বলে, প্রয়োজন হলেই তারা ঘনিষ্ঠ হয়, প্রয়োজন শেষ হলে সরে দাঁড়ায়। এই সম্পর্কটি যদি নিরাপত্তা-চশমার বাইরেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায়, তবে এটি আরেকটি ‘কৌশলগত রোমান্স’ মাত্র। যেমন অতীতেও হয়েছে লক্ষ্য পূরণ বা সরকার পরিবর্তনের পর মিলিয়ে গেছে।’
পলিট্যাক্টের প্রধান কৌশলবিদ আরিফ আনসার বলেন, ‘পাকিস্তান আবারও এক বড় কৌশলগত মোড়ে দাঁড়িয়ে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে চীনের দিকে ঝুঁকবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট ও ইরানের ভূমিকাও কতখানি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর।’
তবে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মারভিন ওয়েইনবাউম সতর্ক করেন, ‘এই সম্পর্কের পুনর্গঠন আপাতত সাময়িক। এই প্রশাসনের সঙ্গে কিছুই স্থায়ী নয়। তারা মুহূর্তেই অবস্থান বদলে ফেলতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘যদি পাকিস্তান ইরান সংকটে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে এই সম্পর্ক নতুন অর্থ পেতে পারে। কিন্তু তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এই প্রশাসনের সঙ্গে কিছুই নিশ্চিত নয়। যেকোনো মুহূর্তে নাটকীয় মোড় নিতে পারে।’
পর্দার আড়ালের ক্ষমতা
এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী। দেশটির রাজনীতি ও সমাজজীবনের ওপর তাদের প্রভাব ব্যাপক।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা সরাসরি দেশ শাসন করেছে। গত বছর বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকারটিও অনেকের চোখে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের নেতৃত্বাধীন সামরিক কাঠামোর ছায়াতলে পরিচালিত হচ্ছে।
ইতিহাসও এই ধারার সাক্ষী। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। এরপর জেনারেল জিয়াউল হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এদের সবাইকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। তবে তখন তারা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে আইয়ুব খানের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ফিল্ড মার্শালের পদমর্যাদা পাওয়া আসিম মুনিরের উত্থান আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানে প্রকৃত ক্ষমতা এখনো বেসামরিক সরকারের হাতে নয়, বরং সেনাবাহিনীর হাতেই রয়েছে।
তবে নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রাজা আহমাদ রুমি সতর্ক করে বলেন, প্রতীকী ঘটনা আর বাস্তব পরিবর্তনের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।
“এই ট্রাম্প-মুনির বৈঠক যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্কের স্থায়িত্বকে নিশ্চিত করলেও এটি বেসামরিক কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে গেছে। ফলে গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থকদের চিন্তার কারণ আছে। যদি এটি নতুন করে সম্পর্কে শুরু হয়, তবে বলতেই হয়— ‘খাকি’ আবারও ব্যালটকে হারিয়ে দিয়েছে।
পলিট্যাক্টের প্রধান বিশ্লেষক আরিফ আনসারও এই মূল্যায়নে একমত। তিনি বলেন, ‘এই বৈঠক পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্যকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। দেখিয়ে দিয়েছে কে এখনো ‘আসল ক্ষমতার অধিকারী’।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের গোপন কার্যক্রম পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর ফলে দেশে এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে জাতির ভবিষ্যতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো গোপনে, আলোচনা বা জাতীয় ঐক্যমতের বাইরেই নেওয়া হয়। আর এতে নাগরিক ও রাজনৈতিক মহলে হতাশা ও আস্থাহীনতা বাড়ছে যা দেশটির ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।’
ওএফ