Logo

আন্তর্জাতিক

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা

উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৮:২৭

উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি

ইরান থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তেল আবিবের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে জড়ো হয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। ছবি : সংগৃহীত

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান নজিরবিহীন সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যা পুরো অঞ্চলকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও পাল্টা হামলায় উভয় দেশেই বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। এদিকে সংঘাতের সপ্তম দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছে। ইরানের সবচেয়ে বড় হামলায় ইসরায়েলের সোরোকা হাসপাতাল ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিহত-আহতের সংখ্যা বাড়ছে। এই সংকট নিরসনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসেছে, কিন্তু সমাধানের পথ এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা, তেলের দাম বৃদ্ধি ও আঞ্চলিক অস্থিরতা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সংঘাতের তীব্রতা নতুন মাত্রা পায় বৃহস্পতিবার সকালে, যখন ইরান থেকে ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ইতিহাসের অন্যতম বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ইরনা জানিয়েছে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বিরশেবার প্রধান সামরিক কমান্ড অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স সদর দপ্তর এবং একটি সামরিক গোয়েন্দা শিবির।

ইরানের দাবি, তাদের হামলা ছিল সুনির্দিষ্ট এবং সরাসরি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে, যার ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

তবে এই হামলায় বেসামরিক স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিরশেবার সোরোকা হাসপাতাল ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শকওয়েভে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এই হামলায় দেশজুড়ে অন্তত ৬৫ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গের ভাষায়, এই হামলা হয়েছে ‘ইসরায়েলের হৃদয়ে’। তিনি মনে করেন, এই হামলার মাধ্যমে ইরান প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েলের কোনো স্থানই তাদের আওতার বাইরে নয়।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে হুংকার দিয়ে বলেন, ‘আমরা তেহরানের অত্যাচারীদের থেকে এর পুরো মূল্য আদায় করব।’

নেতানিয়াহু সরকার এটিকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা হিসেবে প্রচার করছে। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগও আবেগঘন বার্তায় বলেছেন, ‘নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে একটি শিশু, তাদের শয্যার পাশে একজন মা... এগুলোই ছিল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু।’

ইরানের হামলার জবাবে ইসরায়েলও বসে থাকেনি। 'অপারেশন দ্য রাইজিং লায়ন' নামে তারা ইরানে পাল্টা অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ইসরায়েল ইরানের আরাক শহরে অবস্থিত ভারী পানির পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালায়। এ চুল্লিটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারী পানি পারমাণবিক চুল্লি শীতলীকরণে ব্যবহৃত হয় এবং এর উপজাত হিসেবে প্লুটোনিয়াম পাওয়া সম্ভব, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

যদিও ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।

ইসরায়েলি হামলায় ইরানে হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা ৬৩৯ জনে পৌঁছেছে এবং আহত হয়েছেন ১,৩২০ জনের বেশি। নিহতদের মধ্যে ২৬৩ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১৫৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। যদিও ইরানের সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা কিছুটা কম দেখানো হচ্ছে।

এই সংঘাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো সিদ্ধান্ত নেননি যে, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সরাসরি জড়াবে কি না। তবে হোয়াইট হাউসে চলছে ব্যাপক আলোচনা। একদিকে নেতানিয়াহু চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ‘বাংকার বিধ্বংসী বোমা’ ব্যবহার করে ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হোক। অন্যদিকে, ট্রাম্প আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি যুদ্ধে জড়াতে অনাগ্রহী।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি ঘাঁটি থেকে তাদের যুদ্ধবিমান ও জাহাজ সরিয়ে নিয়েছে। কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি, যা এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনা, সেখানেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ২০২০ সালে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার উদাহরণ টেনে বলছেন, সীমিত আকারের হামলা চালালেই তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেবে না।

তবে অনেক বিশ্লেষক ও এমনকি মার্কিন সিনেটররাও এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, মার্কিন হামলা হলে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে।

এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান।

অন্যদিকে, ইরান-ইসরায়েল সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতাও তুঙ্গে। আজ শুক্রবার (২০ জুন) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। ইরান, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার অনুরোধে এ বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। ইরান জাতিসংঘে পাঠানো এক চিঠিতে অভিযোগ করেছে যে, এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ‘অনস্বীকার্য প্রমাণ’ রয়েছে এবং ইসরায়েলকে শুধু সামরিক সহায়তা নয়, হামলার পরিকল্পনাতেও সাহায্য করছে ওয়াশিংটন।

এদিকে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ইরান। তেহরানের অভিযোগ, আইএইএ-র ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ প্রতিবেদনের কারণেই ইসরায়েল তাদের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর অজুহাত পেয়েছে।

যদিও আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্লোসি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, এমন কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বক্তব্যকে ‘অনেক দেরিতে আসা সত্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

এই উত্তেজনার মধ্যে উত্তর কোরিয়া কঠোর ভাষায় ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছে এবং ইরানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলি হামলাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এবং ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেছে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকি প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি, যা তার সতর্ক অবস্থানকেই স্পষ্ট করে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে একটি টাইম বোমার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইরান ও ইসরায়েলের সরাসরি সংঘাত এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বশক্তির মেরূকরণ পুরো অঞ্চলকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে যেমন চলছে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়া, তেমনি অন্যদিকে চলছে কূটনৈতিক সমাধানের ক্ষীণ প্রচেষ্টা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত, তেহরান বা তেল আবিবের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক কোনো আশার আলো দেখাতে পারবে কি না, নাকি এই সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নেবে, তা দেখার জন্য বিশ্ব এখন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।

বিকেপি/এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ইরান ইসরায়েল জাতিসংঘ ডোনাল্ড ট্রাম্প

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর