গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে গুলি
ইসরায়েলি সেনাদের নৃশংস কৌশল ফাঁস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ২০:৫০

গাজার বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র ও তার আশেপাশে অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) গত এক মাস ধরে পরিকল্পিতভাবে গুলি চালিয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে।
সেনাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপের ভিত্তিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, এসব মানুষ কোনো ধরনের হুমকি তৈরি না করলেও, তাদের সরিয়ে দিতে বা ছত্রভঙ্গ করতে সেনাদের গুলি চালানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ত্রাণকেন্দ্র ও জাতিসংঘের খাদ্য ট্রাকের আশেপাশে গুলিতে অন্তত ৫৪৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি। তবে কতজন সরাসরি আইডিএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন, সে সংখ্যা এখনো নিশ্চিত নয়।
একজন আইডিএফ সেনা হারেৎজকে বলেন, ‘প্রতিদিন যেখানে আমি দায়িত্ব পালন করেছি, সেখানে এক থেকে পাঁচজন পর্যন্ত মানুষ মারা যেত। তারা কোনো অস্ত্রধারী নয়, শুধু খাবারের জন্য এসেছিল। কিন্তু আমরা ওদের শত্রু বলেই গুলি চালাতাম। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো গ্যাস বা বিকল্প ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।’
অনুসন্ধানে উঠে আসে, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র খুলে দেওয়ার আগে বা বন্ধ হওয়ার পর মানুষ জড়ো হলে, তাদের ওপর ট্যাংকের মেশিনগান, মর্টার ও গ্রেনেড দিয়েও হামলা চালানো হয়। কখনো কখনো শিশু বা কিশোরদের মাটির ঢিবির আড়ালে দাঁড়িয়ে খাদ্য ট্রাকের দিকে দৌড়াতে দেখা গেলেই সরাসরি গুলি ছোড়া হয়।
ইসরায়েলি এক সেনা বলেন, ‘এটা কোনো সতর্কতা নয়। প্রতিবারই কেউ না কেউ মারা যায়। কেউ প্রশ্ন তোলে না কেন শেল ছোড়া হলো, বরং প্রশ্ন করলে কমান্ডাররা ক্ষেপে যান।’
আইডিএফের আইন পরিদপ্তর ইতোমধ্যে এসব ঘটনায় সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ খতিয়ে দেখতে ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং অ্যাসেসমেন্ট মেকানিজম’ নামক ইউনিটকে দায়িত্ব দিয়েছে। তবে হারেৎজ জানায়, এটা কেবল গুটিকয়েক ঘটনার তদন্ত। অন্যদিকে প্রতিদিনই অসংখ্য নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ মারা যাচ্ছেন।
আইডিএফের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই মৃত্যু শুধু ভুল সিদ্ধান্ত বা দুর্বল নেতৃত্বের কারণে নয়, বরং এটা মাঠপর্যায়ের কমান্ডারদের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটি আদর্শের প্রতিফলন। যার মাধ্যমে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোর একটি গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসরায়েলের তত্ত্বাবধানে, যুক্তরাষ্ট্রের ইভানজেলিকাল গোষ্ঠী ও প্রাইভেট মিলিশিয়ার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান প্রধান একজন মার্কিন ধর্মীয় নেতা, যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ।
এই কেন্দ্রগুলোতে মার্কিন ও ফিলিস্তিনি কর্মী কাজ করছে; কেন্দ্রের ভেতরে আইডিএফ প্রবেশ করতে পারে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘিরে রাখা হয়েছে স্নাইপার, ট্যাংক, মর্টারসহ বিভিন্ন সামরিক বাহিনী। এমনকি আইডিএফ সমর্থিত ‘আবু শাবাব’ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীও দায়িত্বে রয়েছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা নিজেরাও জানি না কে কাকে গুলি করছে। যে অঞ্চলে মানুষ খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ায়, সেখানে এখন শেল ফাটে।’
এক সেনা বলেন, ‘একবার রাতে মর্টার বন্ধ থাকায় কিছু মানুষ এগিয়ে আসতে শুরু করেন। তখন আবার মর্টার শেল ছোড়া হয় এবং সেগুলোর একটি গিয়ে পড়ল লোকজনের ওপর।’
আরেকজন রিজার্ভ সেনা কর্মকর্তা জানান, ‘এই মাসেই একবার এক চৌরাস্তায় ট্রাকের জন্য অপেক্ষমাণ জনতার দিকে গুলি ছোড়া হয়। এতে আটজন নিহত হন, যাদের মধ্যে কিশোরও ছিল। আমাদের বলা হয় তারা হুমকি ছিল। অথচ তারা আমাদের বাহিনী থেকে শত শত মিটার দূরে ছিল। এই মানুষগুলো শুধু খাদ্য নিতে এসেছিল।’
আইডিএফের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার মতে, এসব ঘটনায় সেনাবাহিনীর নৈতিক অবক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন আর কেউ প্রশ্ন করে না কেন গুলি চালানো হলো—সেটা যেন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে উঠেছে। বরং সেনাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, ‘গাজায় কেউ নিরীহ নয়, বরং সবাই সন্ত্রাসী’।
এক উচ্চপদস্থ সামরিক আইনজীবী বলেন, ‘প্রতিদিন যদি ডজন ডজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, তখন আর এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মর্টার, ড্রোন, আর্টিলারি দিয়ে ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের ওপর হামলা—এটা যুদ্ধাপরাধ নয় তো কী?’
এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানায়, হামাস একটি বর্বর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যারা গাজার জনগণকে অনাহারে রাখছে ও তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আইডিএফ জিএইচএফের কার্যক্রমকে সহায়তা দিচ্ছে যেন খাদ্য বিতরণ নিরাপদে সম্ভব হয়। ঘটনার তদন্ত চলছে, আরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নতুন সাইনবোর্ড, বেড়া ও রুট তৈরি করা হয়েছে।
ওএফ