‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আটকের ভয়ে গুরুগ্রাম ছাড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫০

দিল্লি লাগোয়া গুরুগ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাসিন্দা আতঙ্কে ফিরে আসছেন। ফাইল ছবি
কেউ সাতদিন আটক থাকার পরে ছাড়া পেয়েও ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছেন না- যদি আবারও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। অন্য কেউ আবার ট্রেনের রিজার্ভেশন কবে পাবেন, সেই আশায় রয়েছেন– যেদিন টিকিট পাবেন, সেদিনই চলে যাবেন।
অনেকে আবার ট্রেনের টিকিটের অপেক্ষা না করে নিজেরাই বাস ভাড়া করে পাড়ি দিয়েছেন দেশের বাড়ি – পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার দিকে। মোটামুটিভাবে জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের।
কারও চিন্তা হচ্ছে যে কাজকর্ম ছেড়ে দেশের বাড়িতে ফিরে গেলে সেখানে রেখে আসা ছোট সন্তান আর বয়স্ক বাবা-মাকে কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে।
এরা সবাই কর্মসূত্রে দিল্লি লাগোয়া গুরুগ্রামে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের এই বাসিন্দারা সম্প্রতি সেখানকার পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে।
স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন মুকুল শেখ বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ এখান থেকে চলে গেছে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সবাই ভয় পাচ্ছে যে পুলিশ যদি আবার আটক করে বাংলাদেশি সন্দেহ করে, তাহলে কী হবে।’
গত কয়েক মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবৈধ ‘বাংলাদেশি’ ধরার যে অভিযান চলছে, সেই প্রক্রিয়াতেই আটক করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদেরও। ওইসব রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে আটক হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই করা হচ্ছে।
আবার এমন ঘটনাও সামনে এসেছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
‘ভয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছি না’
মালদা জেলার চাঁচোলের বাসিন্দা আনিসুর রহমান স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে গুরুগ্রামে থাকেন প্রায় আট বছর ধরে। নিজে গাড়ি ধোয়ার কাজ করেন, আর তার স্ত্রী গৃহকর্মী। ছেলেও কাজে লেগে পড়েছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে গুরুগ্রামের আরও অনেক বাংলাভাষীর মতোই তাকেও পুলিশ আটক করেছিল পরিচয় যাচাইয়ের জন্য।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের চাঁচোল থানা থেকে আমার পরিচয় যাচাই করিয়ে আনার পরে আমাকে ছেড়েছে। সাত দিন আটকিয়ে রেখেছিল সেক্টর ১০এ-তে একটা কমিউনিটি সেন্টারে।’
তার কথায়, ‘আমার আধার কার্ডসহ সব পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই মানেনি পুলিশ। সাত দিন পরে আমাকে ছেড়েছে। কিন্তু এই যে আটকে রাখল, তারপর ছেড়ে দিল, কোনো কাগজপত্র কিছু দেয়নি। কোনো প্রমাণ নেই যে আমার পরিচয় ভেরিফাই করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই অবস্থায় কোনো কাগজ ছাড়া আমি বাইরে বেরতেও ভয় পাচ্ছি – যদি আবারও ধরে নিয়ে যায়!’ তিনি জানান, ঘরে ফেরার পর থেকে তাই তিনি আর বাইরে বের হননি একবারও।
তিনি বলেন, ‘আমি আবার পুলিশের কাছে যাব কদিন পরে, দেখি যদি কোনো লিখিত কিছু দেয়। আর যদি না দেয়, দোসরা অগাস্টের ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছি, সেদিনই বাড়ি ফিরে যাব।’
পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি ঠিকই, তবে বাড়ি ফিরে এসে কীভাবে সংসার চলবে, সেটাই এখন তারা বড় চিন্তা।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী-ছেলে মিলে মাসে হাজার ৭০ টাকা রোজগার করতাম। এদিকে আবার বেশ কিছু ধারও রয়েছে। এখন বাড়ি ফিরে কীভাবে সংসার চালাব জানি না। কিন্তু এখানে আর নয়।’
তার সঙ্গে আটক হয়েছিলেন, এরকম চার জন ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন।
‘এখানে এসেই ফেঁসে গেলাম’
মালদারই বাসিন্দা মুকুল হোসেন গুরুগ্রামে এসেছেন মাত্রই বছর খানেক হলো। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। তিনিও আনিসুর রহমানের সঙ্গেই আটক হয়েছিলেন গুরুগ্রাম পুলিশের হাতে।
বুধবার (৩০ জুলাই) দিবাগত রাতে মুকুল হোসেন দিল্লি থেকে ট্রেনে চেপেছেন মালদা জেলায় তার বাড়ি ফিরে আসার জন্য।
তিনি জানান, ‘আমি মাত্রই এক বছর হলো এখানে কাজে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসেই তো ফেঁসে গেলাম। পূর্বপুরুষরা সবাই এদেশের বাসিন্দা, সব পরিচয়পত্র থাকার পরেও আটক হয়ে থাকলাম। এখন তো মনে ভয় ধরে গেছে। আর এদিকে আসব না।’
মুকুল হোসেন ট্রেনের টিকিট পেয়ে গেছেন, তবে অন্য অনেক মানুষ ট্রেনের টিকিট না পেয়ে নিজেরাই বাস ভাড়া করে চলে আসছেন পশ্চিমবঙ্গে। গুরুগ্রামের নানা এলাকা থেকে রোজই এরকম দুই বা তিনটে করে বাস ছাড়ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুপান্থ সিনহা দুই সপ্তাহের মধ্যে দুবার গিয়েছিলেন গুরুগ্রামের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে যখন এদের আটক করে রেখেছিল, তখন একবার গিয়েছিলাম। আবার কদিন আগেও গিয়েছিলাম। সংখ্যাটা বলা কঠিন, কিন্তু অনেক ঘর দেখেছি ফাঁকা পড়ে আছে। মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে গুরুগ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। খোলাখুলি কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন এরা।’
শ্রমিক সংগঠক মুকুল শেখ বলছিলেন যে তার এলাকায় যত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন, তারা প্রায় সবাই মুসলমান, কিন্তু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মোটামুটি থেকেই গেছেন এখনো।
‘দেশে ফিরে তো যাব, কিন্তু খাব কী’
একটি ফুড ডেলিভারি অ্যাপের ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন নূর আলম। অন্যের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া নূর আলমের এখন দুশ্চিন্তা যে তার নিজের পরিবারকে কী খাওয়াবেন।
তিনি বলেন, ‘দেশের বাড়িতে মা-বাবা আছে, ছোট সন্তানটাও তাদের কাছেই থাকে। এখানে আমি আর আমার স্ত্রী থাকতাম। এখানে যা পরিস্থিতি, তাতে দেশে তো ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু গিয়ে সংসারের মানুষকে কী খাওয়াব!’
নূর আলম পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা।
গুরুগ্রাম পুলিশ তাকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে ছয় দিন আটকে রেখেছিল একটি কমিউনিটি হলে। মালদার পুলিশ তার পরিচয়পত্র যাচাই করে গুরুগ্রাম পুলিশকে চিঠি পাঠানোর পরে তাকে ছাড়া হয়েছে।
নূর আলম বলেন, ‘অনেক বাংলাভাষীই চলে গেছেন। আমার চেনাশোনা ১০টা পরিবার এখনো রয়েছে। আমরা ট্রেনের টিকিট পাচ্ছি না। যেদিনের টিকিট পাব, সেদিনই চলে যাব।’
গ্রামে তার শুধু বসতভিটাই আছে, কোনো চাষের জমি নেই। তাই কোনো ব্যবসা করা যায় কি না, সেটা ভাবছেন তিনি।
নিজের গ্রামে ফিরে এসে কীভাবে সংসার প্রতিপালন করবেন, এই চিন্তা থেকেই অনেকে আবার ফিরেও যাচ্ছেন পুরোনো জায়গায়।
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, ‘বিভিন্ন রাজ্যে যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের অনেকে যে ফিরে আসছেন, এটা সত্য। তবে আবার এটাও ঘটনা অন্য রাজ্যের পুলিশের হাতে আটক হওয়া, এমনকি বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাদের, তাদেরই অন্যতম মেহবুব শেখ-এর মতো অনেকে নিজেদের কাজের জায়গায় ফিরেও যাচ্ছেন। যেমন ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশার অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন অথবা ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন বলে জানতে পেরেছি।’
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছেন যেসব পরিযায়ী শ্রমিক নানা রাজ্য থেকে ফিরে আসছেন, তাদের উপার্জনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছে তার সরকার। তথ্যসূত্র-বিবিসি।
এমবি