
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা ও বাণিজ্য শুল্ক বৃদ্ধি বিষয়টি অনেকের কাছে শুধু রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি নিয়েই সীমাবদ্ধ মনে হলেও, আসলে তা অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক।
বিবিসি নিউজ বাংলায় বুধবার (১৩ আগস্ট) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং কূটনৈতিক বহুস্তরীয় কারণ।
তেলের অভিযোগ : শুধু আভাস, কিন্তু মূল কারণ নয়
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ভারতের ওপর বাণিজ্য শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করার ঘোষণা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া থেকে তেল আমদানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে এসেছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে পরোক্ষভাবে জিইয়ে রাখছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর বাণিজ্য শুল্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রকাশ্যে জানানো হয়।
তবে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য অ্যান্ড্রু সুশেন্তসভ এসব দাবিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন না। তিনি জানান, ‘ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনায় দ্বিগুণ শুল্ক আরোপ করলেও, সেটাই আসল কারণ নয়। ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পেছনে আরও বড় রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে।’ তার মতে, এটা শুধুমাত্র তেলের ব্যবসায়িক দিক নয়, বরং বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থের প্রশ্ন।
ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশ এবং দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। চিনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সীমান্তীয় উত্তেজনার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত তাদের ‘বিশ্ব নেতৃত্ব’ মেনে নিক এবং পশ্চিমা সামরিক-রাজনৈতিক ব্লকের অংশ হিসেবে কাজ করুক।
তবে ভারতের স্বাধীন ও বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতি এই প্রত্যাশাকে পুরোপুরি মেনে নেয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে গভীর ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ভারতের কৌশলের অন্যতম ভিত্তি। সুশেন্তসভ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ভারতকে এসব সম্পর্ক থেকে দূরে সরাতে পারবে না। ভারতের জন্য তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
বাণিজ্য শুল্ক : চাপের হাতিয়ার
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য শুল্ককে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা তেলের ব্যবসাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসলে ভারতের স্বাধীন নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও আলোচনাও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে। এতে ইউক্রেন সংকটেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বিচ্যুতির ছাপ দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সমঝোতার পথে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীরতা ও সম্প্রসারণ
অমিত ডোভালের রাশিয়া সফর, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়, বিমানের যন্ত্রাংশ উৎপাদন, রেলপথ উন্নয়নসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদারিত্বের বিস্তার— এসব ভারতের রাশিয়ার প্রতি অটল অবস্থান প্রদর্শন করে। রাশিয়ার গণমাধ্যমও ভারতের অবস্থানকে ‘যৌক্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছে।
বিশ্ব বাজারে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের রূপান্তর
ভারত-রাশিয়ার মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব কমানো এবং স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের বৃদ্ধি— যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে দু’দেশের এই পদক্ষেপ নয়া বাণিজ্য পথের সূচনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তাদের কৌশলগত অংশীদার হিসাবে রাখতে চায়, কিন্তু ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কারণে এই চাপ বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না।
সুতরাং, রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণেই ট্রাম্পের ক্ষোভকে সীমাবদ্ধভাবে দেখা ঠিক হবে না। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ভারতের রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করার একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক খেলায় একটি অংশ মাত্র। ভারতের অবস্থান এ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে, যা সময়ের সঙ্গে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
(সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা, ১৩ আগস্ট ২০২৫)
এমএইচএস