Logo

আন্তর্জাতিক

আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের ৪ বছর

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:২২

আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের ৪ বছর

ছবি : আল জাজিরা

২০০১ সালের ৭ অক্টোবর, আফগানিস্তান দখল করতে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। এরপর দীর্ঘ ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও ত্যাগের পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। সেদিন তালেবান যোদ্ধারা প্রায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করে এবং দ্রুত পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। 

এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্র-এর পতন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আর তালেবান দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে।

কাবুল পুনর্দখলের ৪ বছর পর তালেবান দাবি করছে তারা ‘নিরাপত্তা ফিরিয়ে এনেছে, সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে হাঁটছে।তবে সমালোচকদের মতে দেশটি এখন গভীর আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা, সংকোচিত স্বাধীনতা এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আছে।’

২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর তালেবান একটি কেন্দ্রীভূত সরকার গড়ে তোলে এবং সেখানে কেবল নিজেদের শীর্ষ নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে, বাদ দেয় জাতিগত সংখ্যালঘু ও বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে। এই সময়টাতে নারীদেরকেও সম্পূর্ণভাবে সরকারি পদ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এ কারণে শুরু থেকেই তাদের এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসছে আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

আফগান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ স্বীকার করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য, এমনকি ওয়াশিংটনে অবস্থিত আফগান দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণ কাবুলে হস্তান্তর করতে বলা হলেও এ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া আসেনি। মুজাহিদ বলেন, ‘আফগান জনগণ তাদের অধিকার চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আমাদের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, যেমনটি রাশিয়া করেছে।’

কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীদের শিক্ষা ও কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও স্বচ্ছ নজরদারির অভাব তালেবানের বৈধতাকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।

সংবিধানহীন শাসনব্যবস্থা

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার চার বছর পরও দেশটির জন্য কোনো নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এক ধরণের আইনি শূন্যতায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশটি চলছে ‘অস্থায়ী সরকার’ ব্যবস্থায়, যেখানে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনসুর আহমদজাই মনে করেন, পরিষ্কার সংবিধান না থাকায় ক্ষমতা ও আইন নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা জনগণ ও সরকারের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে। তার মতে, চার বছর ধরে কেবল অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র চালানো শাসনক্ষমতার দুর্বলতা প্রকাশ করে।

অর্থনীতিবিদ সিরাজউদ্দিন বলছেন, দক্ষ ও শিক্ষিত তরুণদের বিদেশে চলে যাওয়া রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করছে। তিনি মনে করেন, মেধা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাবে তালেবান সরকার কার্যকর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি বাস্তবায়নে হোঁচট খাচ্ছে।

নিরাপত্তায় সাফল্য ও অর্থনীতিতে অগ্রগতি

তালেবান সমর্থকদের মতে, গত চার বছরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে। দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘর্ষের হার কমেছে। আগে যেখানে নিয়মিত হামলা ও সংঘাত চলত, সেখানে এখন তুলনামূলক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে আফগানি মুদ্রার মান অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে, যদিও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও বিদেশি সম্পদ জব্দ থাকার কারণে তীব্র সংকটে রয়েছে দেশটি। তালেবান কিছু অবকাঠামোগত প্রকল্প যেমন, সড়ক ও বিদ্যুৎ খাতে কাজ শুরু করেছে, যাকে তারা ‘ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক জাগরণ’ বলে দাবি করছে।

তবে নারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াকে দেশটির অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এর ফলে মানবসম্পদ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তালেবানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু পর্দার বিধানে থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেকটাই ছাড় দিচ্ছে তালেবানরা। নারীদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন ও শরিয়তের বিধিবিধান মেনে তাতে অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদানের অনেক সংবাদও স্থানীয় মিডিয়ায় দেখা যায়। 

দোহা চুক্তির প্রধান প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে দোহা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে তালেবান প্রতিশ্রুতি দেয় যে, আফগান মাটিকে কোনো গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের নিরাপত্তা হুমকির কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না। একই সঙ্গে আফগানদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সর্বজনীন সরকার গঠনের কথাও বলা হয়েছিল।

কিন্তু আফগান বিশ্লেষকরা বলছেন, এ চুক্তির বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। শুধু সেনা প্রত্যাহারই সম্পন্ন হয়েছে। দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আতমারের মতে, সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিশ্রুতি, অভ্যন্তরীণ শান্তি আলোচনা এবং স্থায়ী সরকার গঠনের বিষয়গুলো উপেক্ষা করার ফলে প্রজাতান্ত্রিক সরকার ধসে পড়েছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট আরও গভীর হয়েছে।

চলমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ

তালেবান দাবি করছে তারা দেশজুড়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তবে বাস্তবে ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) এখনো বড় হুমকি। নিয়মিত তাদের হামলার খবর পাওয়া যায়। আফগান নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ জামশিদ মনে করেন, তালেবান অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম সীমিত করতে সক্ষম হলেও আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা কঠিন।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে অনিশ্চয়তা

৪ বছর পেরিয়ে গেলেও রাশিয়া ছাড়া কোনো বড় শক্তিধর দেশ এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কেবল রাশিয়া তালেবানকে নিজেদের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে এবং নিজেদের মাটিতে আফগান দূতাবাস চালু করেছে, যা কূটনৈতিক সমর্থন হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি চীন ও ভারত নিজেদের ভৌগলিক অবস্থান ও নিরাপত্তার স্বার্থে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নরম করেছে। তবে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের দিক দিয়ে চীন সহযোগিতার হাত অন্য সবার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের এক শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন তালেবানকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে রাখা হবে কি না তা পর্যালোচনা করছে। তবে তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে কাবুলে এখনো মার্কিন কূটনীতিকরা ফেরেনি।

ভবিষ্যতের প্রশ্ন

ক্ষমতায় আসার পর তালেবান সরকার আফগানিস্তানকে এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একদিকে আপাতদৃষ্টিতে ভেতরে নিরাপত্তা উন্নত হয়েছে, অপরদিকে বাইরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির তীব্র সংকট। তালেবান নেতৃত্ব দাবি করছে তারা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটছে। কিন্তু সমালোচকদের মতে সংবিধানহীন শাসন, নারীদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর অনুপস্থিতি দেশকে আরও দীর্ঘ সময় পিছিয়ে রাখবে।

তাই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, তালেবান কি সত্যিই একটি সশস্ত্র আন্দোলন থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল সরকারে রূপ নিতে পারবে? নাকি আফগানিস্তান আরও বহু বছর অভ্যন্তরীণ সংকট ও আন্তর্জাতিক চাপের চক্রে বন্দি হয়ে থাকবে?

সূত্র : আল জাজিরা

আইএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর