নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ‘অকাল’ মেনোপজ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২১

সময়ের আগে মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার ঘটনা ভারতে নারীদের মধ্যে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমনকি তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলছে। খবর বিবিসি’র।
গত বছর প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যেসব নারীদের স্বাভাবিক সময়ে (৪৫ থেকে ৫০ বছর বা ৫০ এর বেশি) রজঃনিবৃত্তি হয়েছে, তাদের তুলনায় সময়ের আগে মেনোপজ হয়েছে এমন নারীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
শুধু হৃদরোগই নয়, মেনোপজের পর সাধারণত নারীদের হাড়ের সমস্যা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, ওজন বৃদ্ধি, হট ফ্ল্যাশ-ইত্যাদির মতো যেসব সমস্যা দেখা যায়, এসবের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায় প্রিম্যাচিওর মেনোপজের ক্ষেত্রে।
চিকিৎসক এবং কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. অরূপ দাস বিশ্বাস বলেন, ‘মেনোপজ নিশ্চিতভাবেই নারীদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। সময়ের আগে যে নারীদের মেনোপজ লক্ষ্য করা যায়, তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বেশি।’
প্রিম্যাচিওর ও আর্লি মেনোপজ
সাধারণত ভারতে নারীদের ৪৫ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে ৪০ বছর থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে যেমন মেনোপজ হওয়া বিরল নয়, তেমনই এখানে ৫৫ বছরেও নারীদের মেনোপজ দেখা যায়।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কৃষ্ণা ঘোষ বলেন, ‘মেয়েদের ঋতুচক্র একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা একটা বয়সে শুরু হয় এবং একটা বয়সে এসে বন্ধ হয়ে যায়।’
‘কিন্তু কার ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব কোন বয়সে শুরু হবে এবং কখন বন্ধ হবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। হরমোন, ওবেসিটি, লাইফস্টাইল ইত্যাদি ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে।’ একইভাবে মেনোপজ কোন বয়সে এসে হবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে ভারতে নারীদের সাধারণত, ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে রজঃনিবৃত্তি দেখা যায়। আবার তার আগেও দেখা যায়।’
সাধারণত, ৪৫ বছরের নিচের নারীদের মেনোপজ হলে তা আর্লি মেনোপজ। যদি ৪০ বছরের আগে হয়, তাহলে তাকে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ বলে।
বেঙ্গল অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও চিকিৎসক বাসব মুখার্জী বলেন, ‘নারীদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের আগে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার পেছনে যে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, সেই তালিকায় রয়েছে বংশগত কারণ, জেনেটিক কারণ, অটোইমিউন ডিসিজ ইত্যাদি।’
‘এছাড়া সার্জিক্যাল কারণে সময়ের আগেই পিরিয়ড বন্ধ হতে পারে। এছাড়া রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপির কারণে ওভারির ওপর প্রভাব পড়লে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও সময়ের আগেই পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
সমীক্ষা কী বলছে?
‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রাইসিং প্রিম্যাচিওর মেনোপজ অ্যান্ড ভ্যারিয়েশন্স বাই এডুকেশন লেভেল ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৪.৬৬ শতাংশ নারীর মেনোপজ দেখা গেছে।
গত বছর প্রকাশিত ওই গবেষণামূলক প্রতিবেদন বলছে, ৪০ থেকে ৪৪ বছরের নারীদের মধ্যে ১৬.২ শতাংশের মেনোপজ লক্ষ্য করা গেছে।
৪০ থেকে ৪১ বছরের নারীদের মধ্যে ১১.৮১ শতাংশের, ৩৫-৩৯ বছরের নারীদের মধ্যে ৫.৫ শতাংশের এবং ৩০-৩৪ বছরের নারীদের মধ্যে ২.৩৬ শতাংশের মেনোপজ দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, প্রতি ক্ষেত্রেই গ্রামীণ ভারতে বসবাসকারী নারীদের মধ্যে মেনোপজের সংখ্যা বেশি।
ওই গবেষণামূলক প্রতিবেদনে শহর ও গ্রামে তারতম্যের নেপথ্যে কারণ হিসাবে আর্থ-সামাজিক ফ্যাক্টর, শিক্ষা, নারী স্বাস্থ্যের বিষয়ে শিক্ষা ও প্রচারের অভাবসহ একাধিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্য মেনোপজাল ট্রানজিশন অ্যান্ড কার্ডিওভাস্কুলার রিস্ক’ শীর্ষক গবেষণামূলক প্রতিবেদন আবার বলছে, মেনোপজের ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’ একজন নারীর প্রজনন সংক্রান্ত বিষয়ে পরিবর্তনের যেমন ইঙ্গিত দেয়, তেমনই হরমোন, মেটাবলিক (বিপাকীয়) এবং কার্ডিওভাসকুলার পরিবর্তনেরও সঙ্গেও তার যোগ আছে।
যে নারীদের প্রিম্যাচিওর এবং আর্লি মেনোপজ হয় বা সার্জিক্যালি ইন্ডিউসড মেনোপজ (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মেনোপজের মধ্য দিয়ে যান) তাদের ‘কার্ডিওমেটাবলিক চেঞ্জের’ ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মেনোপজের সঙ্গে হৃদরোগের যোগ আছে?
ডা. কৃষ্ণা ঘোষ বলেন, ‘মেয়েদের ঋতুচক্রের সঙ্গে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণ এবং তাদের মাত্রার তারতম্যের যোগ রয়েছে। এই দুই হরমোন মেয়েদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
তিনি ব্যাখ্যা করেন, এ হরমোনগুলো শুধু নারীদের প্রজননের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে। এই হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে তার প্রভাব পড়ে শরীরের ওপর।
ডা. অরূপ দাস বিশ্বাস ব্যাখ্যা করেন, ‘পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে নারীদের মেনোপজ না হওয়া পর্যন্ত পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের ঘটনা কম। তবে ডায়াবেটিস থাকলে তা প্রযোজ্য হয় না। সেক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়েরই কার্ডিওভাস্কুলার ডিসিজের সমান ঝুঁকি থাকে।’
‘নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পর প্রথম দিকে, পুরুষ ও নারী দু’জনেরই কার্ডিওভাস্কুলার ডিসিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সমান সমান। তারপর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষেত্রে ওই ঝুঁকি বেড়েও যায়।’ তিনি জানান, প্রিম্যাচিওর মেনোপজের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়তে পারে।
তার কথায়, ‘প্রিম্যাচিওর মেনোপজের ক্ষেত্রে রিস্কগুলো সবই বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সাধারণভাবে যে সময়ে নারীদের মেনোপজ হয় সেই বয়সে একজনের মেনোপজ হয়েছে এবং একজনের প্রিম্যাচিওর মেনোপজ হয়েছে- এই দু'জনকে তুলনা করলে দেখা যাবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কার্ডিওভাস্কুলার ডিসিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি।’
এর কারণ কী? এর কারণ হলো ইস্ট্রোজেন লেভেল।
ডা. দাস বিশ্বাস বলেন, ‘ইস্ট্রোজেন হার্টকে প্রোটেকশন দেয়। ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে গেলে তাই হার্টের ওই প্রটেকশনও চলে যায়।’
‘পাশাপাশি ধমনীর একেবারে ভেতরের আস্তরণ অর্থাৎ এন্ডোথেলিয়াম ভাস্কুলার সিস্টেমকে ভালো থাকতে সাহায্য করে ইস্ট্রোজেন। এন্ডোথেলিয়াম ডিসফাংশান হলে বা সহজভাবে বলতে গেলে সঠিকভাবে কাজ না করলে ধমনীর ক্ষতি দ্রুত হয় এবং হার্টের ক্ষতিও তাড়াতাড়ি হয়। ইস্ট্রোজেন এন্ডোথেলিয়াম ডিসফাংশানও প্রিভেন্ট করে।’
এক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক বাসব মুখার্জী।
তার মতে, ‘ইস্ট্রোজেন হার্টকে ভালো রাখে, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গেও হার্টের অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। যেহেতু একাধিক কারণে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়, তাই একটা বয়সের পর বলা মুশকিল এর পেছনে কোন ফ্যাক্টর কতটা কাজ করেছে যেমন বয়স, লাইফস্টাইল, মেনোপজ বা অন্য কোনো কারণ।’
‘৫০ বছরের পর এই সমস্ত ফ্যাক্টর মিলে মিশে যায়। তবে ইন্ডিভিজুয়ালি আমরা বলতে পারি মেনোপজের সঙ্গে হৃদরোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং মেনোপজের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’
নারী বনাম পুরুষ
পুরুষ এবং নারী দু'জনের ক্ষেত্রেই কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে একাধিক কারণ।
অধ্যাপক ও চিকিৎসক দীপঙ্কর মুখার্জী ব্যাখ্যা করেছেন, পুরুষ ও নারী দু'জনের ক্ষেত্রেই প্রায় একই ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ কাজ করে, যেমন হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, ধূমপান, ফ্যামিলি হিস্ট্রি, খ্যাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা ইত্যাদি। কিন্তু এক্ষেত্রে জেন্ডার স্পেসিফিক (লিঙ্গ ভিত্তিক) কিছু বিষয়ও রয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘হৃদরোগ পুরুষ এবং নারীদের ক্ষেত্রে আলাদা হয় এমন নয়। কিন্তু সাধারণত দেখা গেছে যে ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজে নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় ৫-১০ বছরের ডিলে দেখা যায়। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে।’
‘এখন ওই সময়সীমার পর নারীদের ক্ষেত্রে যে হার্টের সমস্যা দেখা যায় তার প্রভাব এবং জটিলতা তুলনামূলকভাবে অনেক ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে। এর পেছনে কারণ জেন্ডার-স্পেসিফিক। ‘ওই ৫-থেকে ১০ বছরের যে ডিলে দেখা যার তার নেপথ্যে ইস্ট্রোজেন রয়েছে বলে মনে করা হয়।’
এসএসকেএম হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রিম্যাচিওর মেনোপজের ক্ষেত্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
তিনি বলেন, ‘৪০ বছরের নিচে বিশেষত ৩০ থেকে ৩৫ বছরের নারীদের মধ্যে প্রিম্যাচিওর মেনোপজের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। তা সে সার্জিক্যালি ইন্ডিউসড মেনোপজ হোক বা অন্য কোনো কারণে।’
তাহলে উপায়?
চিকিৎসকদের মতে মেনোপজের উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময় থেকেই একাধিক বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপও নিতে হবে।
ডা. দাস বিশ্বাস বলেছেন, ‘হরমোনের মাত্রার তারতম্যজনিত সমস্যার মোকাবিলার জন্য মেডিক্যাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি রয়েছে। অর্থাৎ হরমোনের মাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চিকিৎসা। মেডিক্যাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি কতদিন হবে এবং তার মাত্রা কত তা স্থির করবেন চিকিৎসক। কারণ এর বিভিন্ন সাইড এফেক্ট দেখা যায়।’
‘এছাড়া নির্দিষ্ট কেসে নির্দিষ্ট রোগের ঝুঁকি মাথায় রেখে তার চিকিৎসাও করা হয়। যেমন ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাওয়া বা হৃদরোগের যদি কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তার চিকিৎসা করা হয়। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করা, ব্যালেন্সড জীবনযাত্রা ইত্যাদি প্রয়োজন। পাশাপাশি মন ভালো রাখাও দরকার।’ কারণ মেনোপজের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৩৫ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘গতবছর আমার ডিম্বাশয় বাদ দিতে হয়েছিল। তার আগে চিকিৎসক আমাকে সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান প্রজনন ক্ষমতা হারাব আমি।’
‘যেহেতু আমার পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে, তাই কী কী বিষয়ে নজরে রাখতে হবে তাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রিম্যাচিওর মেনোপজের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি যেটা দরকার সেটা হলো পরিবার ও নিকট ব্যক্তিদের সাপোর্ট। কারণ এখনো নারীদের প্রজনন ক্ষমতার নিরিখে বিচার করা হয়।’
এমবি