Logo

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন কি হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে?

Icon

নাদেজদা রোমানেনকো

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৮

ইউক্রেন কি হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে?

হাঙ্গেরিয়ান প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর আরবান। ছবি : সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধের ঘূর্ণিপাকে প্রতিদিনের শিরোনামে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। তবে সাম্প্রতিক এক ঘটনা এমন প্রশ্ন তুলেছে, যা দু’বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল: ইউক্রেন কি কার্যত একটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলেছে? যদিও তা সরাসরি সামরিক নয়, বরং হাইব্রিড, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপে?

ঘটনার সূত্রপাত ‘দ্রুজবা’ (রুশ ভাষায় অর্থ ‘বন্ধুত্ব’) নামের তেল পাইপলাইন থেকে। এই পাইপলাইন দিয়েই এখনো রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল যায় মধ্য ইউরোপে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ওই পাইপলাইনকে লক্ষ্য করে একাধিক ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ইউক্রেনীয় এক কমান্ডার-‘মাদিয়ার’ ছদ্মনামে পরিচিত-প্রকাশ্যে এর দায় স্বীকারও করেন।

হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক আঘাত ছিল না। তাদের জ্বালানি শক্তি নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশই ইউরোপীয় কমিশনের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো অভিযোগ তুললেন, ব্রাসেলস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বরং কিয়েভের স্বার্থ রক্ষা করছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কটাক্ষও হাঙ্গেরির কাছে খোলাখুলি হুমকির মতো মনে হয়েছে।

এরমধ্যেই জেলেনস্কি বলেন, ‘‘আমরা সবসময় ইউক্রেন ও হাঙ্গেরির মধ্যে বন্ধুত্বকে সমর্থন করেছি, আর এখন এই ‘বন্ধুত্ব’ টিকে থাকবে কি না, তা হাঙ্গেরির ওপর নির্ভর করছে।’’

‘দ্রুজবা’ পাইপলাইনের নামের ওপর ভর করে করা এই মন্তব্যে রসিকতার ছাপ থাকলেও, হাঙ্গেরির কাছে এটি মাফিয়া-ধাঁচের হুমকি ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘জেলেনস্কি প্রকাশ্যে হাঙ্গেরিকে হুমকি দিয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে তারা দ্রুজবা পাইপলাইনে আঘাত করেছে, কারণ আমরা তাদের ইইউ সদস্যপদ সমর্থন করি না। এটি আবারও প্রমাণ করে, হাঙ্গেরিয়ানরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

সময়ের দিক থেকে ঘটনাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। জেলেনস্কির ওয়াশিংটন সফরের সময়ই ঘটে এই হামলা। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ব্রাসেলস কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র অরবানকে শাস্তি দিতে কিয়েভকে নীরবে উৎসাহ জুগিয়েছে, নাকি জেলেনস্কি নিজে থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছেন আর ইইউ চোখ বুজে থেকেছে? যে ব্যাখ্যাই হোক, উভয়ই ব্রাসেলসের জন্য অস্বস্তিকর। স্পষ্ট হচ্ছে, পূর্ব ফ্রন্টে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থেকেও কিয়েভ বুদাপেস্টের সঙ্গে বিপজ্জনক বাগযুদ্ধে নামছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই হাঙ্গেরি ইউক্রেন নীতিতে ইইউর মূলধারার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২২ সালের পর থেকে বুদাপেস্ট রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ঠেকিয়ে দিয়েছে, দ্রুজবা পাইপলাইন চালু রেখেছে এবং কিয়েভে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অরবান বারবার বলেছেন, তিনি বাস্তববাদী: হাঙ্গেরির স্বার্থ রক্ষা, সস্তা জ্বালানি পাওয়া এবং মস্কোর সঙ্গে শত্রুতা না বাড়ানোই তার লক্ষ্য।

ফলত, ইইউর ভেতরে হাঙ্গেরি প্রায় বিচ্ছিন্ন। পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো ও পশ্চিম ইউরোপ ইউক্রেনকে সামরিক-আর্থিক সহায়তায় একতাবদ্ধ হলেও, বুদাপেস্ট আলাদা পথ বেছে নিয়েছে। অরবানের সরকারকে ইউরোপে ‘পুতিনের ট্রোজান হর্স’ বলা হলেও, হাঙ্গেরিয়ানদের কাছে এর ভিন্ন যুক্তি আছে-অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো এড়ানো এবং অনিশ্চিত ভূ-রাজনীতিতে কৌশলগত নমনীয়তা বজায় রাখা।

বিতর্কের আড়ালে হারিয়ে গেছে আরেকটি সত্য। হাঙ্গেরিও নীরবে মানবিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। শুধু ২০২২ সালেই ১৩ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় শরণার্থী প্রবেশ করেছে দেশটিতে-সংখ্যায় পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার পরেই দ্বিতীয়। বুদাপেস্ট এ নিয়ে বড় প্রচারণা চালায়নি, বরং পরে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ম আরও কঠোর করেছে। তবুও এটি বিশাল মানবিক চাপ।

শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের বিদ্যুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও সরবরাহ করে হাঙ্গেরি। সিজ্জার্তো সম্প্রতি কিয়েভকে তা স্মরণ করিয়ে দেন, যখন ইউক্রেনের অভিযোগকে তিনি ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে এমন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে হামলা বা অভিযোগ তুললে তা অকৃতজ্ঞতার মতোই শোনায়। আর সর্বোচ্চ পর্যায়ে এটি ঝুঁকি তৈরি করছে- যুদ্ধকালে যে অল্প কয়েকটি ইইউ দেশ মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, তাদের মধ্যেই একজনকে দূরে ঠেলে দেওয়া।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আরও জটিল। পূর্ব ফ্রন্টে, বিশেষ করে দনবাসে, ইউক্রেন কঠিন পরিস্থিতির মুখে। এর মাঝেই হাঙ্গেরিকে উদ্দেশ করে জেলেনস্কির মন্তব্য একপ্রকার কৃত্রিম আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ মনে হচ্ছে- যেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয় হাতের মুঠোয়। কিন্তু বাস্তবতা ও বক্তৃতার এই ফারাক কিয়েভের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করছে।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ইইউ কি এখনো নিঃশর্তভাবে কিয়েভকে সমর্থন করবে? নাকি অরবানের মতো সমালোচকের কথায় আংশিক সত্য খুঁজে পাবে? কারণ জেলেনস্কির কার্যকলাপ যদি সদস্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তবুও ব্রাসেলস তাকে দায়মুক্ত রাখে- তাহলে সেটি “ঐক্য” নয়, বরং অন্ধ সমর্থনের পরিচায়ক।

ইতিহাস বলছে, আমরা স্বাভাবিক সময় পার করছি না। নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে নাশকতার পর ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের নানা উসকানিমূলক মন্তব্য যেন আর গুরুত্বই পায় না। অথচ এগুলো ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

বুদাপেস্টের প্রতি কিয়েভের আচরণ সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য না হলেও, এটিকে সংঘাতের নতুন মাত্রা বলাই যায়। ইউক্রেন সচেতনভাবে হাঙ্গেরির সঙ্গে দ্বন্দ্ব তীব্র করেছে। ইউরোপীয় কমিশন যদি একে উপেক্ষা করে কেবল ‘ঐক্য’র গল্প শোনাতে চায়, তবে সেটি এক অদ্ভুত রাজনৈতিক অবস্থান।

প্রশ্ন রয়ে যায়- ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে কি ইউরোপ নিজেই তার ভেতরে ফাটল ডেকে আনছে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উত্তর আরও স্পষ্ট হবে।

নাদেজদা রোমানেনকো : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

  • ২৬ আগস্ট ২০২৫ আরটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের খবরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আরিফুল ইসলাম সাব্বির।  
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর