Logo

আন্তর্জাতিক

ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি, ভেনেজুয়েলার সমর্থনে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ

Icon

হোসে লুইস গ্রানাডোস সেজা, ভেনিজুয়েলা অ্যানালাইসিস

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৭

ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি, ভেনেজুয়েলার সমর্থনে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ

লন্ডনে অবস্থিত ভেনেজুয়েলা দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ।

ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শনিবার (৩০ আগস্ট) বিশ্বের একশরও বেশি শহরে ভেনেজুয়েলা ও তার সার্বভৌমত্বের সমর্থনে বিক্ষোভ হয়েছে। 

লন্ডন, জোহানেসবার্গ থেকে শুরু করে সিডনি ও মেক্সিকো সিটি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এ বিক্ষোভগুলোয় ছিল একটাই বার্তা- ‘ভেনেজুয়েলা কোনো হুমকি নয়; ভেনেজুয়েলা আশার প্রতীক।’ প্রতিবাদকারীরা ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

মেক্সিকো সিটির এক সমাবেশে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা পাওলো লিডাল্ডো ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন জানান। তিনি সতর্ক করে দেন, এ ধরনের সামরিক পদক্ষেপ কেবল ভেনেজুয়েলার জন্যই নয়, বরং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

এ মাসের শুরুতেই ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার উপকূলে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। ওয়াশিংটন এ পদক্ষেপকে ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও এতে উদ্বেগ ছড়ায় যে, এর আড়ালে হয়তো ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপের পরিকল্পনা আছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোর মাথার উপর ৫০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

মাদুরো মার্কিন পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সীমান্ত ও আঞ্চলিক জলসীমায় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি জাতীয় বলিভারিয়ান মিলিশিয়ার চার মিলিয়নেরও বেশি সদস্যকে সংগঠিত করার আহ্বান জানান তিনি। তার মতে, মার্কিন আগ্রাসন প্রতিহত করার একমাত্র উপায় হলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

এদিকে মার্কিন রাজনীতিতেও এ নিয়ে বিভাজন স্পষ্ট। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র মাইকেল ফ্লিন ও কংগ্রেসম্যান কার্লোস গিমেনেজ মাদুরোর পতনের আহ্বান জানিয়ে লড়াইমূলক বিবৃতি দেন। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এখনকার নৌবাহিনী গঠন সরাসরি আক্রমণের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এটি বেশি ‘বন্দুকযুদ্ধের কূটনীতি’— অর্থাৎ শক্তি প্রদর্শন করে মানসিক চাপ সৃষ্টি।

২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভেনেজুয়েলায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন কূটনীতিক জেমস স্টোরি গার্ডিয়ানকে বলেন, সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো আসলে শাসন পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তি প্রদর্শনের অংশ। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ক্রিস্টোফার সাবাতিনির ভাষায়, ‘এটি অপেশাদার মনোবিজ্ঞান,’ যার উদ্দেশ্য মাদুরোর অভ্যন্তরীণ বৃত্তের মধ্যে ধাক্কা দেওয়ার প্রচেষ্টা।

গত এক দশক ধরে ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলায় অভ্যুত্থান চেষ্টাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভাড়াটে আক্রমণের ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে সাবেক আইনপ্রণেতা হুয়ান গুয়াইদোকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে স্বীকৃতি- সবই সেই প্রচেষ্টার অংশ।

অ্যাক্সিওসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন পদক্ষেপের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশাসনের ভেতরেও সংশয় রয়েছে। ট্রাম্পের এক কর্মকর্তা এ পদক্ষেপকে ১৯৮৯ সালে পানামায় নরিয়েগার বিরুদ্ধে অভিযানের সঙ্গে তুলনা করলেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে এটি মূলত ভেনেজুয়েলার নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য।

‘প্রেসিডেন্ট বিকল্পের একটি তালিকা চেয়েছেন। কী করা হবে, তা শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত,’ কর্মকর্তাটি অ্যাক্সিওসকে জানান।

ওয়াশিংটন বোগোটাকে আশ্বস্ত করেছে, ভেনেজুয়েলায় কোনও সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করা হবে না। কলম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজা ভিলাভিসেনসিও জানিয়েছেন, এসব অভিযান শুধু মাদকবিরোধী কার্যক্রমের অংশ। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘমেয়াদে শান্তি চাই। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট সব দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা হেনরিক ক্যাপ্রিলেস বিবিসিকে বলেন, তিনি যেকোনো বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। তার মতে, ‘যারা সামরিক সমাধান চান, তারা ভেনেজুয়েলায় থাকেন না। তারা এর পরিণতিও বোঝেন না।’

যদিও কয়েকটি ক্যারিবীয় দেশ- বিশেষত গায়ানা, যার সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সীমান্ত বিরোধ আছে-মার্কিন পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। আবার ডানপন্থি নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলিও একই অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে, জাতিসংঘে চিঠি দিয়ে মাদুরো সতর্ক করেছেন, মার্কিন এই পদক্ষেপ গোলার্ধের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আঞ্চলিক সংস্থা ALBA-TCP একযোগে মার্কিন সামরিক মোতায়েনের নিন্দা জানিয়েছে। চীনও বলেছে, এটি জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বলপ্রয়োগের এক দৃষ্টান্ত।

ভেনেজুয়েলা বহুদিন ধরেই মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। এই প্রেক্ষাপটে সামরিক শক্তির হুমকি দেশটির সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। মাদুরো সরকারের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বাস্তবতা হলো- বিদেশি হস্তক্ষেপ সাধারণ নাগরিকদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে- এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

ভেনেজুয়েলা–মার্কিন সম্পর্কের এ টানাপোড়েন নতুন নয়। তবে সামরিক মহড়া, যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এবং পুরস্কার ঘোষণার মতো পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে এমন এক মোড়ে ঠেলে দিয়েছে যেখানে কূটনীতি নয়, বরং ভীতি প্রদর্শনই মূল হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো- এটি কি সত্যিই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আনবে, নাকি আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে?

বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শক্তি প্রদর্শনের কূটনীতি সবসময়ই বিপজ্জনক। এর আঘাত প্রথমে লাগে সাধারণ মানুষকে, যাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা আজও অধরা।

আরিফুল ইসলাম সাব্বির/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

যুক্তরাষ্ট্র

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর