মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাদুরোর পাশে একাট্টা জনগণ, বাড়ছে সমর্থন

আলোনসো মোলেইরো
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৩:১৯

গত ২৮ আগস্ট কারাকাসে বিশেষ বাহিনীর এক সদস্যের সাথে নিকোলাস মাদুরো।
ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা আবারও তুঙ্গে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময় বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো হোয়াইট হাউসের সমর্থনে নিজেকে দেশটির ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট’ ঘোষণা করেছিলেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ঘিরে অভিযোগ আরও জোরদার করেছে। তিন সপ্তাহ আগে সন্ত্রাসবাদ ও মাদক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে তার গ্রেপ্তারের তথ্যের জন্য ঘোষিত পুরস্কারের অঙ্ক দ্বিগুণ করেছে ওয়াশিংটন। এর কিছুদিন পরই মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ঘোষণা দেয়, তারা ভেনেজুয়েলার উপকূলে মাদকবিরোধী সামরিক অভিযানে নামছে। আটটি যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান এবং চার হাজার মেরিন মোতায়েনের খবর দেশটিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লিভিট এ অভিযানের ঘোষণা দিতে গিয়ে বলেন, ‘মাদুরো শাসন ভেনেজুয়েলার বৈধ সরকার নয়। এটি একটি মাদক-সন্ত্রাসী চক্র। মাদুরো বৈধ রাষ্ট্রপতি নন, তিনি ওই চক্রের পলাতক প্রধান।’
মাদুরো সরকারও এর পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ জানান, মারাকাইবো অববাহিকা থেকে শুরু করে উপকূল পর্যন্ত আকাশে ড্রোন ও সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে তারা টহল জোরদার করবে। পাশাপাশি কলম্বিয়ার সীমান্তে যৌথ অভিযান চালানোর পরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন থাকবে। এই বাহিনীতে নিয়মিত সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হবে চার মিলিয়ন রিজার্ভ মিলিশিয়া সদস্য।
চাভিসমো এ সময়ে স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে দুটি সামরিক তালিকাভুক্তি অভিযানও শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিও বারবার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছে- বলছে, ‘জাতির মর্যাদা রক্ষা করতে হলে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।’
২০২৪ সালের জুলাই মাসে নির্ধারিত ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে এক দফা সংলাপ হয়েছিল। তবে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতিতে ব্যর্থ সেই আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোর বিরুদ্ধে অবস্থান আরও কঠোর করেছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই কড়া অবস্থানের পেছনে বিরোধী নেত্রী মারিয়া করিনা মাচাদোর অবিচল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কাজ করেছে। আত্মগোপনে থেকেও তিনি ও তার সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন, মাদুরো কেবল ভেনেজুয়েলার জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্যও নিরাপত্তা হুমকি।
মাচাদো সাম্প্রতিক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন হলে উদীয়মান বাজারগুলোতে অদৃশ্য বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত হবে। আমরা লক্ষ লক্ষ ভেনেজুয়েলাবাসী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছি।’
তবে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে ট্রাম্প এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ভেনেজুয়েলার ভেতরে বিরোধীদেরও বিস্মিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলার গণ-নির্বাসন প্রক্রিয়া, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বন্ধ, এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ। যার ফলে USAID–এর মতো সংস্থার সহায়তা থেকেও দেশটি বঞ্চিত হয়েছে।
অন্যদিকে, রাস্তায় আপাত স্বাভাবিক পরিবেশের আড়ালে মাদুরো তার সমর্থকদের একত্রিত করতে সক্ষম হচ্ছেন। সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সদস্যদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এখানেই হুগো শ্যাভেজ যে শক্তি বপন করেছিলেন- জনগণ, সেনাবাহিনী ও পুলিশ মিলে আমরা একত্র। দেশপ্রেমিকদের মনোবলেই আমরা প্রিয় ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষা করব।’
এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেল জাতীয় সংসদেও। সম্প্রতি এক জরুরি অধিবেশনে সংসদ যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির বিরুদ্ধে মাদুরোর পক্ষে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস করেছে। বিরোধী শিবিরের ভেতরের কিছু অংশও এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। সংসদের স্পিকার হোর্হে রদ্রিগেজ বলেন, ‘ভেনিজুয়েলায় অবৈধভাবে প্রবেশ করা কোনো বিদেশি আর কখনো এই দেশ ত্যাগ করতে পারবে না। আমাদের আকাশ, সমুদ্র ও ভূখণ্ড রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।’
রদ্রিগেজ আরও বলেন, ‘ওয়াশিংটনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকৌশল এখন আর কার্যকর নয়। লাতিন আমেরিকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকবিরোধী যুদ্ধে ভেনেজুয়েলার মতো সাফল্য আর কোনো দেশ পায়নি। আমাদের দেশে এক বর্গমিটার কোকা বা গাঁজা উৎপাদন হয় না।’
বহু প্রবাসী ভেনেজুয়েলান ও বিরোধী সমর্থক আশায় আছেন, কোনো বহিরাগত সামরিক হস্তক্ষেপ হয়তো পরিবর্তন আনতে পারে। তবে বাস্তবে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং পরিণতিও হতে পারে ভয়াবহ। বিরোধীদের একটি অংশ মনে করে, ভেতর থেকে ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে চাভিস্তা নেতৃত্ব একসময় আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে- অর্থাৎ রক্তপাত ছাড়াই ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব।
অন্যদিকে শাসক দল এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছে। মাদুরোর ডেপুটি ডিওসদাদো ক্যাবেলো নিজের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘২৬ বছর আগে কমান্ডার শ্যাভেজ ক্ষমতায় আসার পর থেকে কত আক্রমণ প্রতিহত করেছি, তার হিসাব কেউ রাখে না। বিরোধীরা বারবার বলে এসেছে- এবার মাদুরোর পতন হবেই। কিন্তু কিছুই হয়নি। যারা এসব আহ্বানে কান দেয়, তারা শুধু বোকামি করছে।’
নিকোলাস মাদুরো বিদেশি হুমকিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। যুক্তরাষ্ট্র তাকে মাদক- সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে, আর মাদুরো সেই অভিযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিতে। তার সমর্থকরা এটিকে ‘দেশের প্রতি আঘাত, সরকারের প্রতি নয়’ হিসেবে তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক সংকট তাই কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি বহিরাগত হুমকি ও অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের এক অদ্ভুত সমীকরণ। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে-তা নির্ভর করছে শুধু কারাকাসের রাজনীতিবিদদের ওপর নয়, বরং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর হিসাব-নিকাশের ওপরও।
- গত ২৯ আগস্ট ভেনিজুয়েলাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এল পাইস অনলাইন সংস্করণে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আরিফুল ইসলাম সাব্বির/এমবি