‘ওয়ান মার্ডার টেন রুপিস, ওয়ান হাফ মার্ডার ফাইভ রুপিস’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২১

গোপাল মুখার্জী (বাঁয়ে) ও যুগল চন্দ্র ঘোষ (ডানে) ১৯৯৭ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বর্ণনা করেছিলেন ৪৬-এর দাঙ্গায় তাদের ভূমিকা কী ছিল।
‘ওয়ান মার্ডার টেন রুপিস, ওয়ান হাফ মার্ডার ফাইভ রুপিস’–– এটাই ছিল ১৯৪৬ সালের ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর সময়ে যুগল চন্দ্র ঘোষের মানুষ মারার দর; এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি নিজেই। খবর বিবিসি’র।
১৯৯৭ সালে বিবিসিকে তিনি ওই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। উত্তর-পূর্ব কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলের নামকরা ‘মাসলম্যান’ ছিলেন চন্দ্র ঘোষ।
ব্যবসায়ীদের কারও কাছ থেকে এক হাজার, কারও কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা তুলেছেন তিনি, দাঙ্গার সময়ে আবার সেই টাকাই খরচ হত মার্ডার বা হাফ মার্ডার, অর্থাৎ খুন আর গুরুতর আহত করার দাম হিসেবে।
এক বছরেরও কম সময়ে তিনি সম্পূর্ণ পাল্টে যেন অন্য মানুষ হয়ে যান, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে পুরোপুরি গান্ধীবাদী হয়ে গিয়েছিলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
তবে তার মতো ‘হাফ মার্ডার’ নয়, মুসলমান দাঙ্গাকারীদের পুরো ‘খতম’ করারই নির্দেশ দিয়েছিলেন ৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে আরেক পরিচিত নাম ‘গোপাল পাঁঠা’, যার আসল নাম ছিল গোপাল মুখার্জী।
আজকের মধ্য কলকাতার যেখানে সুবোধ মল্লিক স্কয়ার, সেই ওয়েলিংটন স্কয়ার বা কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজার সেইসব এলাকায় তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কলকাতা পুলিশের খাতায় ‘ফেরোশাস’, ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে চিহ্নিত গোপাল পাঁঠা।
‘আমার ছেলেরা কত যে মেরেছে, তার হিসাব নেই,’ বিবিসিকে বলেছিলেন গোপাল পাঁঠা। তবে তার ছেলেদের ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল যে মুসলমান নারীদের বা সাধারণ মুসলমান মানুষের গায়ে যেন হাত না পড়ে।
যুগল চন্দ্র ঘোষের মতো অবশ্য গান্ধীর কাছে দাঙ্গায় ব্যবহৃত অস্ত্র সমর্পণ করেননি গোপাল পাঁঠা বা গোপাল চন্দ্র মুখার্জী।
ঘটনাচক্রে এরা দুজনের কেউই কিন্তু হিন্দু মহাসভা বা অন্য কোনও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, বরং কংগ্রেস নেতাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন দুজনেই।
যদিও গোপাল মুখার্জী দাবি করেছিলেন, ‘আমি ডাক্তার বিসি রায়ের (বিধান চন্দ্র রায়) ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি কোনও পার্টির নই। আমি মানুষকে সাহায্য করি। আমি কোনও পার্টি করি না।’
গোপাল পাঁঠা, যুগল ঘোষের সাক্ষাৎকার বিবিসিকে
গোপাল চন্দ্র মুখার্জী বা গোপাল পাঁঠা এখন আলোচনায় উঠে এসেছেন বিবেক অগ্নিহোত্রীর নতুন ছবি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ এর বদৌলতে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল বিবিসি, ১৯৯৭ সালের ২৫শে এপ্রিল।
বিবিসি রেডিও-র জন্য সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়ারের কাছে একটা ঘরে বসে এক ঘণ্টারও বেশি সময় কথা বলেছিলেন গোপাল মুখার্জীর সঙ্গে। তার ঠিক একদিন আগেই যুগল চন্দ্র ঘোষেরও সাক্ষাৎকার নেয় বিবিসি।
এ দুটি সাক্ষাৎকারই সম্ভব হয়েছিল বিবিসির প্রাক্তন সিনিয়র সহকর্মী নাজেস আফরোজের মাধ্যমে।
নাজেস আফরোজ বলেন, ‘আমি খুঁজে খুঁজে এদের বের করেছিলাম সেই সময়ে। অনেক চেষ্টা করে কথা বলতে রাজি করিয়েছিলাম গোপাল মুখার্জীকে। ওটাই সম্ভবত প্রথম এবং এখন পর্যন্ত তার একমাত্র সাক্ষাৎকার। আর যুগল ঘোষ পরিচিত গান্ধীবাদী মানুষ। তিনি বেলেঘাটার গান্ধী আশ্রম পরিচালনা করতেন।’
চন্দ্র ঘোষ যদিও ৪৬-এর দাঙ্গায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, তবে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরে যে দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতার কয়েকটি এলাকায়, সেসব থামানোর জন্য তার এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক-সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমি নিজের চোখেই দেখেছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাজেস আফরোজ।
ওই সাক্ষাৎকারগুলোর মূল অডিও রেকর্ডিং এখন লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, সোয়াসের আর্কাইভে রাখা আছে।
সেই দুটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এবং আরও কিছু তথ্য জুড়ে এ প্রতিবেদনে কলকাতার দাঙ্গায় এই দুই ব্যক্তির ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘দেড়শো-দুশো মার্ডার’
দাঙ্গা শুরু হওয়ার দিন তিনেক পরে, ১৯ অগাস্ট কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের নেতা ডা. সুরেশ চন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে গাড়িতে চেপে পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়েছিলেন বেলেঘাটা এলাকার ‘মাসলম্যান’ যুগল চন্দ্র ঘোষ।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ওই অংশে দাঙ্গার ভয়াবহতার বর্ণনা দেওয়ার আগে স্বগতোক্তি করে তিনি বলেছিলেন, ‘সব সত্যি কথা বলব?’
তারপরে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘দেখা যায় ডেডবডি সব ঠেলায় বাঁধা রয়েছে তিনটে চারটে করে – অল হিন্দুস। এরপর আমরা ওয়েলেসলি দিয়ে যাচ্ছি ১৯৪৬, ১৯ অগাস্ট। সমস্ত হিন্দু দোকানগুলো পুড়িয়ে, ভেঙ্গে চুরে আর হিন্দু ডেডবডি সব ছড়ানো।’
‘ওখান থেকে পার্ক স্ট্রিটে পড়লাম। পার্ক স্ট্রিট থেকে পার্ক সার্কাসের মোড়ে ওটা – মল্লিক বাজার। ডেডবডি সব ছড়ানো পড়ে রয়েছে। হিন্দুর দোকান সব ফিনিশড্... মুসলিমরা রয়েছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জট পাকাচ্ছে,’ বিবিসিকে বলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
তিনি সেখানেই গাড়ি থেকে নেমে যেতে চেয়েছিলেন, তবে জামা ধরে তাকে আটকান কংগ্রেস নেতা সুরেশ চন্দ্র ব্যানার্জী।
ডা. ব্যানার্জী তাকে সেখানেই বলেছিলেন যে তারা পূর্ব বঙ্গের মানুষ এবং এ ধরনের ছোট ছোট ঘটনা হতেই থাকে সেখানে, তবে তার ‘কাউন্টার জবাব দিতে হয়, না হলে রোখে (থামে) না।’
‘আমি বলি ঠিক আছে দেব, আপনি বাড়ি চলুন, আমাকে গাড়িটা দেবেন,’ বলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
তিনি এ বর্ণনা দিতে শুরু করার ঠিক আগে বিবিসিকে জানান, ‘বললে মিথ্যা হবে না, ওয়েস্ট বেঙ্গলে এই কাউন্টার জবাবটা আমাকে দিয়ে দিতে হয়েছিল।’
ওই গাড়ি নিয়েই তিনি চলে গিয়েছিলেন নিজের এলাকা বেলেঘাটার দিকে।
সেখানকার কাঠের কল আর অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কারও কাছ থেকে এক হাজার, কারও কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা তুলে শুরু করেছিলেন ‘পাল্টা জবাব’ দেওয়ার প্রস্তুতি। সেই অর্থই খরচ হত ‘ওয়ান মার্ডার টেন রুপিস, ওয়ান হাফ মার্ডার ফাইভ রুপিস’ দরে।
নিজেই বলেছিলেন বিবিসিকে যে ‘দেড়শো-দুশো মার্ডার’ করিয়েছিলেন তিনি।
ভারতের কলকাতার রাস্তায় পড়ে আছে লাশ - ১৯৪৬।
‘এক বোতল হুইস্কি দিলেই একটা পিস্তল’
ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে অশান্তি বাঁধতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা সব পক্ষেরই ছিল, তাই প্রস্তুতিও নেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
গোপাল পাঁঠা ১৯৪২ সালের 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'-এর সময়ে থেকেই দলবল জোগাড় করে রেখেছিলেন, তাদের কাছে সেই সময় থেকেই অস্ত্র মজুত ছিল।
তবে ৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে ‘যে যেখান থেকে যা পেয়েছে, সে একখানা ছুরি-কাটারি কি তলোয়ার, বন্দুক, পিস্তল – আর কিছু সিকিওর করা ছিল ৪২-র মুভমেন্টের সময়ে,’ বিবিসিকে বলেন গোপাল মুখার্জী।
তিনি বলছিলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন সৈন্যবাহিনী যখন কলকাতায় অবস্থান নিয়েছিল, তাদের কাছ থেকেও অস্ত্র কিনে রাখা হয়েছিল।
‘আড়াইশো টাকা দিলে একটা ৪৫ পিস্তল (পয়েন্ট ৪৫ পিস্তল) আর একশো কার্টিজ দিয়ে দিত। এক বোতল হুইস্কি কিনে দিলে একটা পিস্তল আর একশো কার্টিজ দিয়ে দিত। এইভাবে সিকিওর করেছি,’ বলেন গোপাল মুখার্জী।
‘প্রথমে আমরা মারামারিটা পছন্দ করিনি’
দাঙ্গার সময়ে মুসলমান-নিধনের জন্যই মানুষ গোপাল পাঁঠার নাম জানেন। তবে তিনি মুসলমানদের জীবনও বাঁচিয়েছিলেন ওই সময়ে। সেই বর্ণনা নিজেই দিয়েছিলেন বিবিসিকে।
১৬ অগাস্ট, যেদিন কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, সেদিন তিনি বিকেল তিনটে পর্যন্ত বৌবাজার এলাকায় দাঙ্গা থামানোর কাজ করছিলেন। তখনই তার কাছে খবর আসে যে তার নিজের পাড়াতেও হামলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি ওখানে থাকার সময়ে আমার এই লোকালিটি থেকে খবর গেল যে ওখানে অ্যাটাক করেছে চাঁদনির (চাঁদনি চক এলাকা) মুসলমানরা। এখানে মুসলিম এলাকা একটা আছে। আমি বললাম তোমরা এখানে দায়িত্ব নিয়ে থাকো। আমি আমার এলাকায়, আমার পাড়ায় কী হচ্ছে সেটা দেখি।’
‘সেখানেও থামানো দরকার, কারণ আমার এখানে কয়েকটা বাড়ি আছে, একটা বাড়িতে একটা মুসলিম মেস ছিল তাতে সাড়ে তিনশো চারশো মুসলমান - এই চাঁদনি বাজারের কর্মচারী তারা। ৩২ এর এক মলঙ্গা লেন – ওই বাড়িটাতে ভর্তি মুসলমান। তার পাশে একটা বাড়ি ছিল স্যালভেশন আর্মির – সে বাড়িটাও খালি ছিল, তাতেও ভর্তি মুসলমান,’ বিবিসিকে জানিয়েছিলেন মুখার্জী।
নিজের পাড়ায় এসে দেখেন যে তার বাড়ির দরজার গোড়াতেই জঞ্জাল জড়ো করে আগুন লাগিয়েছে দাঙ্গাকারীরা, আর সামনে একটা পানের দোকান লুঠ হচ্ছে।
‘আমার হাতে একখানা সোর্ড ছিল, সেই সোর্ডটা দিয়ে যে লুটেরা ছিল তাকে একটা কোপ দিই। সে কাটা পড়ে। তারপরেই কাঠের পিলার ছিল, পিলারে লেগে সোর্ডটা ভেঙ্গে যায়। তখন একগাছা স্টিক নিয়ে তাদের তাড়া করি। পালিয়ে যায়,’ বলেছিলেন গোপাল মুখার্জী।
‘প্রথমে আমরা মারামারিটা পছন্দ করিনি’, জানিয়েছিলেন তিনি।
সেদিন বিকেলে কিছু মুসলমান বন্ধুকে ডেকে তিনি বলেছিলেন যে তার এলাকায় যেন কোনও অশান্তি না হয়। তারা চেয়েছিলেন দাঙ্গা থামাতেই।
‘এখানে হিন্দু-মুসলিম যেমন ভাই-ভাই আছি, থাকব। যেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে হোক। ইন দ্য মিন টাইম কড়েয়ার দিক থেকে একটা গ্রুপ তাসা বাজিয়ে এসে ময়দানের (সেই সময়ের ওয়েলিংটন স্কোয়ার) মধ্যে ঢুকেছে। আমি ওদেরকে ডাকলাম। ডেকে বললাম এদেরকে প্রতিরোধ কর, বাধা দাও। যে গণ্ডগোলগুলো করো না, তোমরা ফিরে যাও,’ বলেছিলেন গোপাল পাঁঠা।
সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল, সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। তবে মি. মুখার্জীর মাথায় তখনও চিন্তা ছিল যে তার এলাকায় এত মুসলমান মানুষ রয়েছেন, তাদের ওপরে কেউ হামলা না করে দেয়।
পাড়ার মুসলমানদের উদ্ধার তার দলের ছেলেদের দিয়ে পাহারা দিয়ে তিনি কাছের বৌবাজার থানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ভারতের কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ ঠোকরাচ্ছে কাক।
‘একটার বদলে দশটা মারবে’
১৬ অগাস্ট বিকেলে যে মুসলিমদের দলটি ওয়েলিংটন স্কয়ারের দিকে এসেছিল এবং যাদের বাধা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন গোপাল মুখার্জী, সেই দলটি আবারও ফিরে এসেছিল পরের দিন, ১৭ তারিখ।
পাড়ায় তখন টহলদার পুলিশ বাহিনী ছিল, তাদের সঙ্গে খাতিরও ছিল গোপাল মুখার্জীর। টহলদার বাহিনীকে তিনি বলেছিলেন যাতে ওই জমায়েত আটকানো হয়।
‘তখন আমার কাছে দুটো ৪৫ পিস্তল – আমেরিকান, সাঁটানো কোমরে। কারণ বলা যায় না তো কী করবে না করবে। দুটো পিস্তল দুপাশে সাঁটানো.. লোডেড। আমি ভেতরে গেছি। আর আমার লোকাল ছেলেরা বলছে দাদা যাবেন না। তা সত্ত্বেও আমি গেছি।’
‘আমার সঙ্গে অনেক ছেলে গেছে, তারা ওয়াচ করছে যে আমাকে ঘিরছে। তখন আমিও লক্ষ্য করলাম যে আমাদের কথা শুনছে না ওরা সারাউন্ডিং ঘিরছে। আমি গুলি চালাতে পারতাম, কিন্তু একটা লাইফের দাম আছে। একটা লাইফ নিতে বেশিক্ষণ যায় না, কিন্তু একটা লাইফকে বাঁচাতে অনেক সময় লাগে।’
‘আমি সিধে কাওয়ার্ডের মতো পালিয়ে গেলাম। লোকজন যাতে না মরে যার জন্য আমি ব্যাক করলাম,’ বিবিসিকে বলেছিলেন গোপাল মুখার্জী।
প্রাথমিকভাবে তিনি যদিও দাঙ্গা থামানোর চেষ্টাই করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন, তবে তার দলের ছেলেরাও যে পাল্টা বহু মানুষ হত্যা করেছে, সেটা রাখঢাক না করেই বলেছিলেন মি. মুখার্জী।
তিনি বলেন, ‘আমি সব লোকাল ছেলেদের কল করে বললাম যে দেখো মারছ বা মারবে, ওরাও যা করছে তোমরাও তাই করবে। তবে এখন দেখছি বর্বরতার দ্বারাই বর্বরতা দমন হবে। সুতরাং ওরা যদি কানে শোন যে একটাকে মেরেছে, তোমরা ওয়ান টু টেন করবে, তোমরা দশটাকে মারবে। তবে এটা বন্ধ হবে। মারবে মানে আধমরা করবে না একদম খতম করবে।’
তার দলের ছেলেরা কত মানুষকে হত্যা করেছিল, তার কোনও হিসাব ছিল না গোপাল মুখার্জীর কাছে।
‘কে কত মেরে এসেছে, সেই লিস্ট রাখিনি বা জানতে চাইনি। আমি অর্ডারটা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি,’ বলেন গোপাল পাঁঠা।
রাস্তায় লাশের স্তূপ
গোটা কলকাতা ততক্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে দাঙ্গায়। কংগ্রেস নেতা ডা. সুরেশ ব্যানার্জীর সঙ্গে গাড়ি চেপে সেই দাঙ্গা বিধ্বস্ত কিছু এলাকা ঘুরে এসে বেলেঘাটার ‘মাসলম্যান’ যুগল চন্দ্র ঘোষ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে তার কথায়, ‘কাউন্টার জবাব’ দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন।
বিবিসিকে তিনি সেই প্রসঙ্গেই বলেছিলেন যে পুরোপুরি খুন করতে পারলে দশ টাকা আর গুরুতর জখম করলে পাঁচ টাকা দেওয়ার কথা।
যে ১৯ অগাস্ট থেকে যুগল ঘোষ ও তার বাহিনী ‘কাউন্টার জবাব’ দিতে শুরু করেছিলেন দশ আর পাঁচ টাকা দরে, তার আগে থেকেই রাস্তায় লাশের স্তূপ জমতে শুরু করে।
ঘটনাচক্রে, রাস্তায় স্তূপাকৃতি লাশ সরাতেও ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগিয়েছিল, তাদেরও লাশ প্রতি পাঁচ টাকা করেই দেওয়া হচ্ছিল। সেই তথ্য ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ফিল্ড মার্শাল ওয়াভেলকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন বাংলার গভর্নর ফ্রেডেরিক বারোজ।
‘ট্র্যান্সফার অফ পাওয়ার’ নামে যে ব্রিটিশ নথির যে বিশালাকার সংকলন আছে, তারই আট নম্বর খণ্ডে রয়েছে বাংলার গভর্নরের ২২ অগাস্ট, ১৯৪৬ সালের সেই বিস্তারিত রিপোর্ট।
দাঙ্গার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে গিয়ে ১৯ অগাস্টের প্রসঙ্গে ওই চিঠিতে বারোজ লিখেছিলেন, ‘রাস্তায় পড়ে থাকা বিপুল সংখ্যক পচাগলা দেহ সরানো আমার কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটা ছিল।
‘কর্পোরেশনের ডোমরা কাজ করছিল না, কিন্তু সেনাবাহিনী আমাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে, স্বেচ্ছাসেবকদের দেহ-পিছু পাঁচ টাকার বিনিময়ে। তারা বহু সংখ্যক দেহ রাতেই সরিয়ে ফেলেছিল,’ বড়লাটকে জানিয়েছিলেন বারোজ।
গান্ধীর সামনে যুগল আর গোপাল
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কলকাতায় স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দাঙ্গার মধ্যেই কলকাতায় এসেছিলেন ১২ অগাস্ট, ১৯৪৭। বেলেঘাটায় এখন যেটি গান্ধী আশ্রম, সেখানেই উঠেছিলেন তিনি। ওই আশ্রমটি পরবর্তীতে পরিচালনা করতেন যুগল চন্দ্র ঘোষ, তবে সেই সময়ে তিনি গান্ধীবাদী ছিলেন না।
বহু মানুষের সঙ্গে তিনিও গান্ধীকে দেখতে গিয়েছিলেন সেই ভবনে, যেটি পরবর্তী জীবনে তারই কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠবে তখন জানতেন না তিনি।
চন্দ্র ঘোষ বিবিসিকে বলেন যে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করানোর জন্য এলাকার প্রভাবশালীদের ডেকে আনার দায়িত্ব তার ওপরে পড়েছিল।
তার কথায়, ‘বেলেঘাটার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাদের আমি সবাইকে খবর দিয়েছি। দুতিন জায়গায় বাধা পেয়েছি, যাদের হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সম্পর্ক। তারা আমাকে বলেছে যে তোমার মাথাটা খেয়েছে। এই লোকটা সর্বনেশে লোক। এ আমাদের দেশ থেকে চুষে, ঠকিয়ে অনেক কিছু নিয়ে চলে গেছে। এর কথা শুন না। তখন আমি তাকে দাবড় দিই এবং বলি ফালতু কথা আপনি বলবেন না, বললে আমি সহ্য করব না।’
সেদিন বিকেল তিনটের সময়ে সভা শুরু করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ।
‘গান্ধীজী বলছেন, খুন কা বদলা খুন – ইসি সে সমসিয়্যা সমাধান নেহি হোগি। আমি এই কথাটা দুচার বার শোনার পর নিজে খুব অভিভূত হয়েছি – এইটাই ঠিক পথ। গান্ধীজী বলছেন তোমার ছেলেকে খুন করবে, তুমি তার বদলা আরেকজনকে খুন করবে তার–– এই খুনের বদলা খুন চলতে থাকবে, সমস্যা মিটবে না। কিছু বরদাস্ত করতে হবে – বিশ, পঞ্চাশ মরে যাবে, সেটা সহ্য করতে হবে। তারপরেই গণ্ডগোল থেমে যাবে,’ বলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
সেই সময়ে গান্ধীর সামনে যুগল ঘোষের অনেক 'চেলাচামুণ্ডা' অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন।
‘পরে আমাকেও মারার জন্য চেষ্টা করেছে। আমি গান্ধী অনুরাগী হয়ে তখন প্রচারে নামি এবং সেইভাবে কাজ করতে থাকি যাতে আর কোনও গণ্ডগোল না হয়। গণ্ডগোল থেমে গিয়েছিল – আর্মসগুলো জমা দিয়েছিল। কিছু কিছু আর্মস - ওয়ান শট বলে একটা বন্দুক তৈরি করেছিল, তারপর পাইপগান টাইপের এসমস্ত যতগুলো ছিল জমা দিল। সোর্ড, বোম এসব জমা দিল। দিয়ে তারা অহিংসবাদী হয়ে পড়ল,’ বলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সভায় বহু মানুষ জড়ো হতেন। ততদিনে বেশিরভাগ মানুষই তার কথা মেনে নিয়েছিলেন যে খুনের বদলে খুন করলে দাঙ্গা থামবে না।
তবে ১৩ কি ১৪ই অগাস্টের সভায় একটা ঘটনা হয়েছিল। সেদিন স্থানীয় হিন্দু মহাসভার কয়েকজন গান্ধীর কথার প্রতিবাদ করেন এবং বলতে থাকেন ‘খুন কা বদলা খুন।’
‘স্লোগান-টোগান দিল, দিয়ে কুৎসিত ভাষা কয়েকটা বলল। তারপরে চলে গেল। কিন্তু ওই গোলমালটুকু একটু জিইয়ে ছিল। জলও হয়েছিল, তাতে গান্ধীজীর তাকিয়া, গদিটা – তুলোর একটা ছোট গদি ছিল উনি বসতেন, পিকদানি এসব কাদায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। গান্ধীজী চুপসে এরকম দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইটপাটকেল এত মেরেছে, ঈশ্বরের কী দয়া গায়ে ইট লাগল না, চারিদিকে ইট একদম পড়তে লাগল,’ বর্ণনা করেছিলেন যুগল চন্দ্র ঘোষ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে একাধিকবার অনুরোধ এসেছিল গোপাল পাঁঠার কাছেও।
‘কংগ্রেস লিডাররা আমার কাছে আসে, যে গোপাল মান-ইজ্জত যাবে, তুমি কিছু যন্ত্রপাতি জমা দাও,’ বলেন গোপাল মুখার্জী।
‘এদের কথা এড়াতে পারলুম না, আমি বললাম আচ্ছা চলুন। যাওয়ার পর .. কেউ একটা ভাঙ্গা পিস্তল দিচ্ছে, কেউ একটা অকেজো রিভলভার দিচ্ছে, কেউ একটা গান দিচ্ছে, কেউ ছুরি দিচ্ছে দুখানা। তারপর আমার ডাক হয়েছে, আমি গেলাম।’
গোপাল পাঁঠা বিবিসিকে বলেন, ‘ইন্টারপ্রেটার ছিল নির্মল বোস (অধ্যাপক নির্মল বসু, মি. গান্ধীর সহকারী) বলল যে গোপাল তোমার কাছে যে অস্ত্রপাতি আছে সব গান্ধীজীকে দাও। তখন আমি বললাম যে যখন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসটা হলো, তখন গান্ধীজী কোথায় ছিলেন! যে অস্ত্র দিয়ে মা বোনের ইজ্জত রক্ষা করেছি, মহল্লা রক্ষা করেছি, সে অস্ত্র আমি একটাও জমা দেব না এবং একটা সূচ দিয়েও যদি কাউকে মেরে থাকি সেটাও জমা দেব না।’
যেসব অস্ত্র তাদের কাছে ছিল, সেগুলো পরবর্তীকালে ডাকাতি-ছিনতাইতেও ব্যবহৃত হয়েছে, সেটাও তিনি বলেন বিবিসিকে।
যুগল চন্দ্র ঘোষ ২০০২ সালে ও গোপাল মুখার্জী ২০০৫ সালে মারা গেছেন।
এমবি