অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের প্রভাবশালী মিত্রকে গুলি করে হত্যা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:২৭

ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে কনজারভেটিভ অ্যাকটিভিস্ট চার্লি কার্ক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন প্রভাবশালী মিত্র ছিলেন।
আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আউটডোর ডিবেট আয়োজনের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় ‘এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শোকার্ত ও ক্ষুব্ধ’ বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। খবর বিবিসি’র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এটাকে ‘আমেরিকার জন্য একটি অন্ধকার মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
এ ভিডিও বার্তায় তিনি আরও বলেন, তার প্রশাসন ‘এ নৃশংসতা ও অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতায় অংশ নিয়েছেন এমন প্রতিটি ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবে। ‘উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক সহিংসতা অনেক নিরীহ মানুষকে আঘাত করেছে,’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত বছর তাকে হত্যার চেষ্টা এবং ইউনাইটেড হেলথ কেয়ারের সিইও ব্রায়ান থম্পসনকে হত্যার কথাও উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। দেশটির এ গভীর রাজনৈতিক বিভক্তির জন্য ট্রাম্প বরাবরই ‘উগ্র বামপন্থিদের’ দোষ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন।
সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছেন তার এমন সব বক্তব্য রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।
এফবিআই পরিচালক ক্যাশ প্যাটেল জানিয়েছেন, আগেই আটক এক সন্দেহভাজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ছাদ থেকে গুলি করা হয়েছে।
গুলি চালানোর পরে অনলাইনে পোস্ট করা একটি ভিডিও বিবিসি ভেরিফাই পরীক্ষা করে দেখেছে।
অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গুলি করার আগে ৩১ বয়সী কার্ককে গণহত্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হচ্ছে।
১৮ বছর বয়সে কার্ক টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ নামে একটি কনজারভেটিভ গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ও তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
প্রায় ২০০ গজ দূর থেকে তাকে গুলি করা হয়েছে : বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
ইউটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রায় ২০০ মিটার (১৮২ মিটার) দূরের একটি ভবন থেকে গুলি চালানো হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস ও ফক্স নিউজসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াগুলোতে এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র অ্যালেন ট্রিয়ানের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রায় ১২টা ২০ মিনিটে প্রায় ২০০ গজ দূরের একটি ভবন থেকে গুলি চালানো হয়। আমাদের জানা মতে, ওই ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং তার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে যান।’
হত্যাকারীর খোঁজে ঘরে ঘরে পুলিশ
ঘটনার পরপরই পুলিশ শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধ, ক্লাস বাতিল। পুলিশ তদন্ত করছে। অবিলম্বে ক্যাম্পাস ত্যাগ করুন। পুলিশের নির্দেশ অনুসরণ করুন।’
দুইজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারে বাধার দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এই হামলার সাথে তাদের যোগসূত্র রয়েছে কি না তা এখনও স্পষ্ট না।
কার্কের হত্যাকারীর খোঁজে পুলিশ ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকার ঘরে ঘরে যাচ্ছে। ডিবেট অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সাথে ক্যাম্পাসের বাইরে বিবিসির সংবাদদাতা কথা বলেছেন।
তারা জানিয়েছেন গোলাগুলির সময় ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে ফেলে আসা যানবাহন বা অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করতে পুনরায় সেখানে যেতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ এলাকায় ঘোরাফেরা করছেন।
১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা
ইউটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মর্মান্তিক এই গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ওরেমের এই ক্যাম্পাসটি আপাতত বন্ধ থাকবে।
‘ইউভিইউ ক্যাম্পাস ১১ থেকে ১৪ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এ সময়ের মধ্যে সব ক্লাস (সশরীরে বা ভার্চুয়াল), ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ইভেন্ট এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। দয়া করে সেভাবে পরিকল্পনা করুন এবং আপনার সময়সূচিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনুন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এখন একটি লাল ব্যানারের সতর্কতা রয়েছে, যেটিতে ১১ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অবহিত করছে।
এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘ইউটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমরা আমাদের ক্যাম্পাসে আসা অতিথি চার্লি কার্কের মর্মান্তিক মৃত্যুতে মর্মাহত ও শোকাহত। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।’
কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না : প্রত্যক্ষদর্শী
কার্ককে গুলি করার সময় তিন হাজারের বেশি লোক আউটডোর এই ইভেন্টে উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন যে, লোকজন সামনে এগিয়ে আসছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, মঞ্চে কার্ককে রক্তাক্ত অবস্থা কাতরাতে দেখা এবং জনগণ আতঙ্কে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজকে প্রথম বর্ষের ছাত্র গ্যাভিন বলেন, ‘এটা একটু অবাস্তব। বিশেষ করে তখন এটা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল।’
‘সবাই প্রার্থনা শুরু করে... তারপর আমরা দৌড়াতে শুরু করি,’ বলেন তিনি।
এ ডিবেট অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডাম বার্থেলোমিউ। ক্যাম্পাসে চার্লি কার্ক আসার প্রতিবাদে যারা বিক্ষোভ করছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। তিনি জানান, একটি গুলির শব্দ শুনতে পান এবং সবাই মেঝেতে পড়ে যান।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং মানুষজন ওই স্থান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করতে থাকে।’
বার্থেলোমিউ জানান, কার্কের বিরুদ্ধে ৫০ থেকে ৬০ জন বিক্ষোভ করছিল।
গুলিবর্ষণের ঘটনার আগে অনুষ্ঠানের পরিবেশ বেশ ভালো ছিল এবং লোকজন ‘ইউএসএ’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। কার্কের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ করছিলেন তারা অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দিচ্ছিল বলে জানান তিনি।
বার্থেলোমিউ জানান অনুষ্ঠানে কোনো নিরাপত্তা না থাকায় তিনি ‘অবাক’ হয়েছিলেন। ‘কেউ আমাকে থামায়নি অথবা আমার ব্যাগ তল্লাশি করেনি,’ বলেন তিনি।
চার্লি কার্ক কে ছিলেন?
কার্ক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে হাই প্রোফাইল কনজারভেটিভ অ্যাকটিভিস্ট এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের একজন। একইসাথে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী।
২০১২ সালে ১৮ বছর বয়সে কার্ক টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ' এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি একটি ছাত্র সংগঠন যেটির লক্ষ্য উদারপন্থি যুক্তরাষ্ট্রের কলেজগুলোতে রক্ষণশীল আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া।
ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বাস এবং পারিবারিক মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ছাত্রদের সাথে বিতর্কের ক্লিপ তার সোশ্যাল মিডিয়া এবং দৈনিক পডকাস্টে প্রায়ই শেয়ার করা হতো।
কার্ক বিবাহিত ছিলেন এবং ছোট দুইজন সন্তান আছে তাদের।
কার্কের নিহতের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টরা নিহত কার্কের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং সহিংসতার প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩-তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বিবিসি নিউজকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আজ, একজন যুবককে তার রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করার সময় ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স- এ এক পোস্টে বুশের পূর্বসূরী বিল ক্লিনটন বলেছেন, তিনি ‘চার্লি কার্কের হত্যায় দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ।’
‘এবং আমি আশা করি আমরা সকলেই কিছু গুরুতর আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে যাব। শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করব। হিলারি এবং আমি এরিকা ও তাদের ছোট দুই সন্তান এবং তাদের পরিবারের জন্য প্রার্থনা করছি,’ লিখেছেন ক্লিনটন।
বুশের উত্তরসূরি বারাক ওবামাও এক্স-এ, তিনি এবং তার স্ত্রী মিশেল ‘আজ রাতে চার্লির পরিবারের জন্য প্রার্থনা করবেন’ বলে লিখেছেন।
ওবামা লিখেছেন, ‘আমরা এখনও জানি না চার্লি কার্ককে গুলি করে হত্যা করতে ওই ব্যক্তিকে কী উৎসাহিত করেছিল, তবে এই ধরনের আমাদের গণতন্ত্রে ঘৃণ্য সহিংসতার কোনও স্থান নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬-তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডের এক্স এ লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে এই ধরনের সহিংসতার কোনও স্থান নেই। এটা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। জিল এবং আমি চার্লি কার্কের পরিবার এবং প্রিয়জনদের জন্য প্রার্থনা করছি।’
কার্কের মৃত্যুতে শোক প্রকাশকারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও মানবসেবা সচিব রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রও রয়েছেন। কেনেডি লিখেছেন, ‘আবারও, একটি বুলেট একটি যুগের সবচেয়ে স্পষ্টবাদী সত্যবাদীকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।’
কেনেডির বাবা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর রবার্ট এফ কেনেডি ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্টের জন্য প্রচারণা চালানোর সময় নিহত হন। ৩৫-তম মার্কিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন নিহত হন তার চাচা জন এফ কেনেডি (জেএফকে)।
একজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান বলেছেন, সহিংসতা চার্লি কার্কের কণ্ঠকে দমন করতে পারেনি এবং কনজারভেটিভ অ্যাকটিভিস্টদের কথা শোনা অব্যাহত থাকবে। মাইক কেলি বিবিসিকে বলেন, ‘এ সহিংসতা আমেরিকার জনগণকে দমন করতে পারবে না।’
ভয়-ভীতি দেখানো ও সহিংসতা আমেরিকার জনগণের উপর কাজ করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের বাক স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে এগিয়ে যাব এবং সেভাবেই প্রচার চালাবো যেভাবে চার্লি সারা জীবন করেছিলেন।’
এমবি