Logo

আন্তর্জাতিক

গাজা নিয়ে ট্রাম্প, হামাস ও ইসরায়েলের অবস্থানে এখনো ‘অস্পষ্টতা’

Icon

বিবিসি

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৪৬

গাজা নিয়ে ট্রাম্প, হামাস ও ইসরায়েলের অবস্থানে এখনো ‘অস্পষ্টতা’

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা পুরোপুরি বন্ধ হবে কি না এবং সেখানে শান্তি ফিরবে কি না— এ নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মেনে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে হামাস, তবে কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে চায় তারা। ট্রাম্প হামাসের বিবৃতিকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ায়ও তাদের ‘আলোচনার’ দাবি নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।

অন্যদিকে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার ‘প্রথম ধাপ’ অনুযায়ী গাজায় সামরিক অভিযান সীমিত করার কথা বলা হলেও হামলা পুরোপুরি বন্ধ হবে কি না— এমন কোনো প্রতিশ্রুতি ইসরায়েল দেয়নি। ট্রাম্প ইসরায়েলকে গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন; তবুও শনিবার (৪ অক্টোবর) ভোরে গাজায় বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় আল-শিফা হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে অন্তত তিনটি স্থানে ইসরায়েলি হামলা হয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে ৬৬ জনের মৃতদেহ এবং ২৬৫ জনকে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীরা পৌঁছাতে না পারায় এখনও অনেক ভুক্তভোগী ধ্বংসস্তূপের নিচে বা রাস্তায় পড়ে আছেন। মন্ত্রণালয় অনাহার এবং অপুষ্টির কারণে দুই শিশুর মৃত্যুর তথ্যও রেকর্ড করেছে; অপুষ্টিতে মোট মৃতের সংখ্যা এখন ৪৫৯, যার মধ্যে ১৫৪ জন শিশু।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হোয়াইট হাউস সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০ পয়েন্টের শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো হলো— 

  • গাজায় সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা।
  • হামাসের হাতে থাকা ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি এবং দুই ডজনেরও বেশি মৃতদেহ ৭২ ঘন্টার মধ্যে মুক্তি দেওয়া।
  • ইসরায়েল শত শত আটক ফিলিস্তিনি এবং গাজার অন্যান্য বাসিন্দাদের দেহাবশেষ মুক্ত করবে।
  • হামাস তাদের অস্ত্রসমর্পন করবে এবং গাজা শাসনে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
  • এসব প্রস্তাবে সম্মত হলে গাজার জন্য ‘পূর্ণ সহায়তা’ অবিলম্বে পাঠানো হবে।
  • ট্রাম্পের নেতৃত্বে এবং প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মত নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি আন্তর্জাতিক ‘শান্তি বোর্ড’ গঠন করা হবে, এবং এর তত্ত্বাবধানে একটি ‘টেকনোক্র্যাটিক, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি’ গাজার প্রশাসন পরিচালনা করবে।

পরিকল্পনাটি ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য একটি সম্ভাবনার দরজা রেখে দিয়েছে, যদিও নেতানিয়াহু পরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র সংক্রান্ত প্রস্তাবটি বাতিল করে দিয়েছেন।

হামাস কোন বিষয়ে সম্মত ও কোন বিষয়ে আলোচনার দাবি করেছে?

গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস শনিবার যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে তারা ট্রাম্পের ২০ পয়েন্টের পরিকল্পনায় পুরোপুরি সম্মতি জানায়নি। তবে যুদ্ধ শেষ করার জন্য পশ্চিমা ও আরব নেতারা যেগুলোকে অতি জরুরি বলে মনে করছিলেন, সেগুলো মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।

হামাস যে বিষয়ে সম্মত হয়েছে 

  • তাদের হাতে থাকা সব ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে হামাস।
  • তারা গাজার প্রশাসন টেকনোক্র্যাটদের হাতে হস্তান্তরের বিষয়ে “ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐকমত্য ও আরব ও ইসলামী নেতাদের সমর্থনের ভিত্তিতে” আলোচনা করতে রাজি আছে বলে জানিয়েছে।

হামাস যে বিষয়ে আলোচনা চাইছে

  • বিবৃতিতে নিরস্ত্রীকরণের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
  • তারা স্পষ্ট করে বলেনি যে ভবিষ্যতে গাজার শাসনব্যবস্থায় তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।

ট্রাম্প এই বিষয়গুলোতে রাজি হবেন কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।

প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় অংশগ্রহণকারী হামাস-মিত্র গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) হামাসের প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে ওই হামলার সময় ইসরায়েল থেকে ধরা পড়া ২৫১ জনের মধ্যে ধারণা করা হয় হামাসের হাতে এখনও ৪৮ জন জিম্মি রয়েছে; তাদের মধ্যে আনুমানিক ২০ জনই জীবিত বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে হামাসের বক্তব্যকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় এগিয়ে নিতে আলোচনাকারী দলগুলোকে আলোচনা শুরু করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। হারেৎজ ও চ্যানেল টুয়েলভের প্রতিবেদন অনুযায়ী আলোচকরা কোথায় ভ্রমণ করবেন তা স্পষ্ট না থাকলেও ‘আজই যাত্রা শুরুর’ নির্দেশ আছে। হামাসের বিবৃতির পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েল প্রস্তুত।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আইডিএফ প্রধান সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে রাতভর বৈঠক করেছেন এবং প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিবৃতিতে গাজায় সামরিক তৎপরতা হ্রাস করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি; তবে সেনারা সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকবে যাতে যে কোনো মুহূর্তে হুমকির জবাব দেওয়া যায়।

এরপর শনিবার সকালে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব গাজা সিটি দখলের তৎপরতা থামাতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে এবং সামরিক তৎপরতাকে প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে বলেছেন। তবুও আইডিএফ সতর্ক করে দিয়েছে যে উত্তরে ওয়াদি গাজা এলাকা ‘একটি বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে রয়ে গেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে, গাজা শহর এখনো ঘিরে রাখা আছে এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ‘চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে’। আইডিএফ-র আরবি ভাষার মুখপাত্র আভিচাই আদরাই এক্স-এ লিখেছেন, রশিদ স্ট্রিট এখনো খোলা আছে যাতে লোকেরা দক্ষিণে সরতে পারে।

রাজনৈতিক বিরোধীদের সমর্থন
ইসরায়েলের বিরোধী দলীয় নেতা ইয়ার লাপিড এবং ডেমোক্র্যাট দলের নেতা ইয়ার গোলান নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন। গোলান এক্স-এ লিখেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্য হলো ট্রাম্পের চুক্তিটি নষ্ট করার সুযোগ কাউকে দেওয়া উচিত নয়— না হামাস, না নেতানিয়াহু ও তার সরকার।’ লাপিড জানিয়েছে, তিনি মার্কিন প্রশাসনকে বলেছেন যে যুদ্ধ শেষের প্রক্রিয়া চালানোর জন্য নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে এবং চুক্তির বিশদ চূড়ান্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে আলোচনায় যোগ দেওয়ার ঘোষণা করা উচিত।

অনিশ্চয়তা ও প্রতিক্রিয়া
হোয়াইট হাউস গত সোমবার একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিভিন্ন সীমা দেখানো আছে; তবে মানচিত্রটি আনুমানিক বলে মনে করা হচ্ছে। যদি সেই সীমানা অনুসরণ করা হয়, তাহলে প্রথম প্রত্যাহারের পরও গাজার প্রায় ৫৫ শতাংশ ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে থাকতে পারে। দ্বিতীয় প্রত্যাহারের পর প্রায় ৪০ শতাংশ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে, যা একটি ‘নিরাপত্তা বাফার জোন’ তৈরি করবে, এরপরও গাজার প্রায় ১৫ শতাংশ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দখলে রাখতে পারে। আইডিএফ-এর নিজেদের মানচিত্রে “বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র” হিসেবে চিহ্নিত এলাকা গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত দেখানো হয়েছে।

বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার কিছু অংশ হামাস গ্রহণ করায় বিশ্বনেতারা তা স্বাগত জানিয়েছে এবং যেসব বিষয়ে সম্মতি আসেনি সেগুলো নিয়ে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘গাজার মর্মান্তিক সংঘাতের অবসান ঘটানোর সম্ভাব্য সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমি সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।’ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়্যার স্টারমার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের আরও আলোচনা করে টেকসই শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্য্যিপ এরদোয়ান ঘটনাকে ‘গঠনমূলক ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর, ফ্রান্স ও ইতালির নেতারা জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধবিরতির তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন হামাসের প্রতিক্রিয়াকে ‘উৎসাহজনক’ বলেছেন এবং অনুরোধ করেছেন— এই মুহূর্তটিকে কাজে লাগাতে হবে।

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও হামাসের আংশিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গাজা এক অনিশ্চিত পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনার সূচনা হয়েছে— কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সম্মতি না মেলায় সংঘাত থামবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বিশ্বের নজর এখন গাজার ওপরেই লেগে আছে।

এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

গাজা শহর ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধ ইসরায়েল ফিলিস্তিন ডোনাল্ড ট্রাম্প

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর