ট্রাম্পের ক্ষোভ, রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২০

ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তির জন্য মস্কোর ওপর চাপ বাড়াতে রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকোয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। খবর বিবিসি’র।
‘যতবার আমি ভ্লাদিমিরের সঙ্গে কথা বলি, ভালো আলোচনা হয়। কিন্তু তা কোথাও পৌঁছায় না। একদমই কোথাও না,’ নেটো মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়ে বৈঠকের পর এমন মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে পরিকল্পিত বৈঠকটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের বিষয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার একদিন পর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
এর আগে বুধবার (২২ অক্টোবর) ইউক্রেনে রাশিয়ার বোমাবর্ষণে শিশুসহ অন্তত সাতজন নিহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘এ অযৌক্তিক যুদ্ধ শেষ করতে পুতিনের অস্বীকৃতি’ জানানোয় নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, এসব তেল কোম্পানি ক্রেমলিনের ‘যুদ্ধ যন্ত্রকে’ অর্থায়ন করে।
‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির এখনই সময়,’ বিবৃতিতে বলেন বেসেন্ট।
বুধবার ওভাল অফিসে রুটের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, পুতিন শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আন্তরিক নন। তিনি আশা করেন নতুন নিষেধাজ্ঞা এই প্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি আনতে সাহায্য করবে।
‘আমার কেবল মনে হয়েছে, সময় এসেছে। আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছি,’ বলেন ট্রাম্প।
তিনি নিষেধাজ্ঞার প্যাকেজটিকে ‘অসাধারণ’ উল্লেখ করে বলেন, রাশিয়া যদি যুদ্ধ বন্ধে রাজি হয়। তবে এ নিষেধাজ্ঞাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
পদক্ষেপটির প্রশংসা করে রুটে বলেন, এটি ‘পুতিনের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করছে’।
‘চাপ দেওয়া প্রয়োজন, আর সেটিই আজ তিনি করেছেন,’ মন্তব্য করেন রুটে।
এ পদক্ষেপটি এমন সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শান্তি প্রস্তাবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো এ সপ্তাহে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, আলোচনায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে বর্তমান ফ্রন্টলাইনে লড়াই বন্ধ করতে মস্কোর অস্বীকৃতি।
গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যও রসনেফট ও লুকোয়েলের ওপর একই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
‘বিশ্ববাজারে রাশিয়ান তেলের কোনো স্থান নেই,’ পদক্ষেপটি ঘোষণার সময় বলেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস।
এ বিষয়ে লন্ডনে রাশিয়ার দূতাবাস থেকে জানানো হয়, তাদের দেশের প্রধান জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।
দূতাবাস আরও জানায়, এসব নিষেধাজ্ঞা ‘উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে’ এবং ‘এ ধরনের চাপ সৃষ্টি শান্তিপূর্ণ আলোচনাকে আরও জটিল করে তোলে ও উত্তেজনা বাড়ায়’।
এ রাশিয়ান দুটি তেল কোম্পানি প্রতিদিন প্রায় ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন (৩১ লাখ) ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। যুক্তরাজ্য সরকারের হিসাব অনুযায়ী, রসনেফট একাই রাশিয়ার মোট তেল উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের দায়িত্বে, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের ছয় শতাংশ।
তেল ও গ্যাস রাশিয়ার প্রধান রপ্তানি পণ্য এবং মস্কোর সবচেয়ে বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত ও তুরস্ক। ক্রেমলিনের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে ট্রাম্প এই দেশগুলোকেও রাশিয়ান তেল কেনা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভেট কুপার ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ‘অত্যন্ত স্বাগত’ জানান।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বুধবার এক্স-এ দেওয়া একটি পোস্টে জানান, তিনি ওইদিন ‘শান্তি প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার অনীহা’ নিয়ে বেসেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।
তিনি আরও জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বুধবার যে নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে, তাতে রাশিয়ান তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
‘ইইউর ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজের আসন্ন অনুমোদনের মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকা উভয় দিক থেকেই স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে— আমরা আগ্রাসীর ওপর যৌথ চাপ বজায় রাখব’, লিখেছেন তিনি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার আরও দুটি বড় জ্বালানি কোম্পানি, গ্যাজপ্রম নেফট ও সুরগুতনেফতেগ্যাস-এর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
হোয়াইট হাউসে রুটে ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্র ও কিয়েভের প্রণীত ১২ দফা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। এ পরিকল্পনায় বর্তমান যুদ্ধরেখা স্থির রাখা, নির্বাসিত শিশুদের ফেরত আনা এবং যুদ্ধরত দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের প্রস্তাব রয়েছে।
পরিকল্পনায় ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন তহবিল, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের সদস্যপদের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ, কিয়েভের জন্য সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানোর কথাও উল্লেখ আছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প বলেন, তিনি বুদাপেস্টে পুতিনের সঙ্গে ‘অর্থহীন বৈঠক’ চান না এবং ইঙ্গিত দেন যে আলোচনায় প্রধান বিরোধের বিষয় হলো —বর্তমান যুদ্ধরেখায় লড়াই বন্ধে মস্কোর অস্বীকৃতি।
ট্রাম্প সর্বশেষ আলাস্কায় এক শীর্ষ সম্মেলনে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। হোয়াইট হাউস আশা করেছিল এর মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কিন্তু তারপরও লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের মধ্যকার প্রস্তুতিমূলক বৈঠকটিও বাতিল করা হয়েছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, একটি ‘ফলপ্রসূ’ ফোনালাপ হওয়ায় এ সপ্তাহের বৈঠকটি আর ‘প্রয়োজনীয় নয়’।
ট্রাম্প বারবার বর্তমান ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
সোমবার তিনি বলেন, ‘যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক’। ‘আমি বলেছি, যুদ্ধরেখায় থেমে যাও। বাড়ি ফিরে যাও। লড়াই বন্ধ করো, মানুষ হত্যা বন্ধ করো।’
রাশিয়া এই ধারণার বিরোধিতা করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘রাশিয়ার অবস্থানের ধারাবাহিকতায় কোনো পরিবর্তন নেই’— যা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রত্যাহারের দাবির দিকেই ইঙ্গিত করে।
বুধবার (২২ অক্টোবর) ট্রাম্প ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর এক প্রতিবেদনেরও সমালোচনা করেন, যেখানে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রাশিয়ার ভেতরে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অনুমতি দিয়েছে। ট্রাম্প একে ‘মিথ্যা খবর’ বলে অভিহিত করেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দূরপাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ অস্ত্র যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারে।
এমবি