Logo

আন্তর্জাতিক

জোহরান মামদানির জয় প্রমাণ করে আমেরিকানরা ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিতে ক্লান্ত

ইনজামামুল হক

ইনজামামুল হক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:১৭

জোহরান মামদানির জয় প্রমাণ করে আমেরিকানরা ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিতে ক্লান্ত

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির জয় পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত না হলেও নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। কারণ, নির্বাচনের আগে প্রায় সব জরিপে দেখা যাচ্ছিল যে, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম অভিবাসী জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে এগিয়ে আছেন।

তবে তাঁর জয় নিশ্চিত ছিল না, কারণ বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল- বয়স্ক ভোটারদের অস্বাভাবিকভাবে বেশি উপস্থিতি, যারা অ্যান্ড্রু কুয়োমোর সমর্থক ছিলেন, ফলাফল উলটে দিতে পারে। কিন্তু তা আর ঘটেনি এবং ৪ নভেম্বরের রাতে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরের বাসিন্দারা প্রথমবারের মতো এক মুসলিম মেয়রকে নিজেদের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করল। 

ডেমোক্র্যাটদের জন্য, বিশেষত প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটদের জন্য- যারা গাজায় গণহত্যার প্রতি নীরব সমর্থন, আইস (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট)–এর অভিযানে নিষ্ক্রিয়তা এবং মূল্যস্ফীতির সমস্যা সমাধানে অক্ষমতার প্রতি হতাশ ছিলেন- এই জয় মূলত তাদের। জোহরান মামদানি, যাঁর বিরুদ্ধে ২০ জনেরও বেশি কোটিপতি লাখ লাখ ডলার ঢেলে প্রচারণা চালিয়েছেন, তাদের দেখিয়ে দিলেন দলের প্রকৃত শক্তি আসলে কোথায় নিহিত।

জেন-জি প্রজন্মের তরুণ ভোটাররা ব্যাপক হারে ভোট দিয়ে মামদানিকে বিজয়ী করেছে। বছরের পর বছর হিলারি ক্লিনটন ও চাক শুমারের মতো নেতাদের পছন্দের ‘মধ্যপন্থী রাজনীতি’র পর অবশেষে এমন একজন মেয়র হলেন, যিনি দলের সাধারণ ভোটারের ভাষায় কথা বলেন। তাঁর জয়ের ব্যবধান স্পষ্ট করে দিল ডেমোক্র্যাটিকরা এতদিন কতটা ভুল ধারণায় ভুগছিল। 

তবে তার এই বিজয়ে অভিবাসী ও মুসলমানদেরও অনেক অবদান রয়েছে। নিউইয়র্ক এমন একটি শহর যা ৯/১১–এর স্মৃতির বয়ে বেড়াচ্ছে। যেই ঘটনার পর রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ও তাতে অর্থায়ন শুরু করে। যা এক নতুন ইসলামবিদ্বেষী যুগের সূচনা ছিল।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিউইয়র্কের রাজনীতিবিদরা ৯/১১–এর স্মৃতিকে বর্ণবাদী বৈষম্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য নিপীড়নের যৌক্তিকতা হিসেবে ব্যবহার করেছেন; এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধেও, যারা শুধু ‘মুসলমানের মতো’ দেখতে। সন্দেহভাজন, নিরাপত্তা হুমকি ও প্রমাণবিহীন হামলার অজুহাতে মুসলিম নারী-পুরুষদের আতঙ্কে রাখা হতো। এফবিআই ও নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের এজেন্টদের মসজিদে পাঠানো হতো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য, মুসলমানদের চাপ দেওয়া হতো যেন তারা একে অপরের বিরুদ্ধে তথ্য দেয়। 

যখনই কোনো মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব আসত, তা প্রবল ইসলামবিদ্বেষের মুখে পড়ত; শহরের ইহুদি–আমেরিকান গোষ্ঠীর তরফ থেকে। যারা ৯/১১–এর ঘটনাকে মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে কোণঠাসা করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

এখানেই জোহরান মামদানির জয়ের আরেকটি তাৎপর্য নিহিত। নিউইয়র্ক সিটি ইসরায়েলের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম ইহুদি শহর। অনেকে ভেবেছিলেন, গাজায় চলমান গণহত্যা ও জোহরান মামদানির প্রকাশ্য ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানের প্রেক্ষিতে তাঁর বিজয় অসম্ভব।

যদিও ইহুদি সম্প্রদায়ের বড় অংশ তাঁর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে; এক্সিট পোল অনুযায়ী, বিশেষত রুশ বংশোদ্ভূত ইহুদিরা সংগঠিতভাবে তাঁর বিরোধিতা করেছে, তবু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ আমেরিকান ইহুদি তাঁকে ভোট দিয়েছে। কারণ, প্রবীণ আমেরিকান ইহুদিদের অধিকাংশই কঠোরভাবে জায়নিস্ট ও ইসরায়েল সমালোচনাকে ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে দেখেন, তবে তরুণ ইহুদিরা অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। 

এটি নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের বিষয়, কারণ তাদের লবি সংস্থা এআইপ্যাক যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট- উভয় দলের প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে, যেন তারা তাদের ইসরায়েল–সমর্থন নিশ্চিত করে। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের বিতর্কে জোহরান মামদানি ছিলেন একমাত্র প্রার্থী যিনি স্পষ্টভাবে বলেন, নির্বাচিত হলে তাঁর ইসরায়েল সফরের কোনো আগ্রহ নেই, বরং তিনি নিউইয়র্কেই থেকে কাজ করতে চান।

অন্য প্রার্থীরা এই অবস্থানে তাঁর কঠোর সমালোচনা করলেও জোহরান নিজের অবস্থানে অটল থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হন। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সেই লবিগুলোর জন্য অস্বস্তিকর, যারা হয়তো এখন ভাবছে; আমেরিকান রাজনীতিবিদেরা কি অবশেষে বুঝতে শুরু করেছেন যে, জনগণ তাদের নেতাদের ইসরায়েল-প্রীতিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে, বিশেষত এমন এক সময়ে যখন তারা নিজের ভাড়া বা খাদ্য ব্যয় সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছে।

নিউইয়র্কের বাইরে ডেমোক্র্যাটরাও বড় সাফল্য অর্জন করেছে, যা আগামী বছরের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি স্পষ্ট পূর্বাভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভোটাররা রিপাবলিকানদের এবং পরোক্ষভাবে ট্রাম্পের এজেন্ডার বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে ভোট দিয়েছে। এমনকি দুর্বল ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছেন।

এটি ওই সকল আমেরিকানদের জন্য সুসংবাদ যারা এ বছরের শুরু থেকে সরকারের অস্থিরতা ও দুর্বলতা দেখে হতাশ ছিলেন। সাধারণত প্রেসিডেন্টরা জনগণের অস্বীকৃতির মুখে পড়তে কিছুটা সময় পান, কিন্তু এবার তা হয়নি।

অভিবাসী ও মুসলমানদের ক্ষেত্রেও সুসংবাদ শুধু নিউইয়র্ক পর্যন্ত সীমিত নয়! ভার্জিনিয়া রাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক মুসলিম নারী যার নাম গাযালা হাশমি লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন। একইভাবে মিশিগানের ডিয়ারবর্ন ও ডিয়ারবর্ন হাইটস শহরেও মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

যখন ৯/১১–এর ঘটনা ঘটে তখন জোহরান মামদানির বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। তাঁর মা মীরা নয়ার, যিনি একজন অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং তাঁর বাবা মাহমুদ মামদানি, উপনিবেশ পরবর্তী অধ্যয়নের একজন বিশিষ্ট গবেষক; সম্ভবত কখনো ভাবতেও পারেননি যে সেই শিশু, যে এমন এক শহরে মুসলিম ছাত্র হিসেবে বড় হচ্ছিল যেখানে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ করা হয়, একদিন সেই শহরের গত একশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী মেয়র হয়ে উঠবেন।

কিন্তু অলৌকিক ঘটনা ঘটে, আর ইতিহাস শেখায়; যাকে একসময় সমাজ ‘অন্য’ বা ‘অচ্ছুত’ বলে মনে করে, একদিন সেই মানুষই নেতৃত্বের আসনে বসে। জোহরান মামদানির গল্প সেইসব মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা, যারা কখনো ভালো সময় ফিরে পাবার আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত কলামিস্ট রাফিয়া জাকারিয়ার লেখা অলম্বনে

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জোহরান মামদানি যুক্তরাষ্ট্র

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর