বিশেষ সাক্ষাৎকার
ইসলামী ব্যাংকিং ও বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মাঝে শিক্ষানীতি সম্পর্ক
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:২৩
ইসলামী ব্যাংকিং ও বাংলাদেশি কওমি শিক্ষার্থীদের পাকিস্তানে অধ্যয়নের সুযোগসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের খবর-কে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জামিয়াতুর রশিদ করাচির মুহাদ্দিস ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান হযরত মুফতি ইহসান ওয়াকার আহমাদ। উর্দুতে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলাদেশের খবরের সহসম্পাদক মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক। এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ পাঠকদের জন্য নিম্নে তুলে ধরা হলো-
ইনজামামুল হক : আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি।
ইনজামামুল হক : আপনি এখন বাংলাদেশ সফরে আছেন- এখানকার মানুষদের কেমন লাগছে আপনার? তাদের আতিথেয়তা সম্পর্কে কী বলবেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জি, আলহামদুলিল্লাহ, আমি খুবই আনন্দ অনুভব করছি। এখানে অনেক আন্তরিকতা অনুভব করছি। মানুষজনের মধ্যে প্রচুর ভালোবাসা আছে, মাশাআল্লাহ। সবাই অত্যন্ত সম্মান দেখিয়েছে এবং এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। খুব আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে।
ইনজামামুল হক : বাংলাদেশের অনেক ছাত্র পাকিস্তানে পড়াশোনার জন্য গেছেন, এবং এখনো যাচ্ছেন। বাংলাদেশি ছাত্রদের সম্পর্কে আপনার মতামত কী? তাদের জ্ঞান, আমল ও মানসিকতার বিষয়ে কিছু বলুন।
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জি, মাশাআল্লাহ, ওখান থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমার মতে, আমরা পাকিস্তানে যে অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থা তৈরি করেছি, তা থেকে বাংলাদেশেরও পূর্ণ উপকার নেওয়া উচিত। এতে দুই দেশের মধ্যে ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
জ্ঞানচর্চার যে ক্ষেত্রে আমরা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি ও সফল হয়েছি, সেটি আমরা আমাদের বন্ধু দেশকে দিতে চাই, যেন তারা উপকৃত হতে পারে। সেটা হোক মাদরাসার পর্যায়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, অথবা প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে- সবখানেই সহযোগিতা সম্ভব। তাই তারা যেন আসে, আমরা তাদের আন্তরিকভাবে বরণ করব। আমরা যা শিখেছি, বুঝেছি, সব তাদের জন্য উন্মুক্ত।
ইনজামামুল হক : বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের থেকে পাকিস্তানের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অনেকাংশেই এগিয়ে রয়েছে। তো বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : আমার মতে, সামাজিকভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় একই রকম। আমি লক্ষ্য করেছি, সেখানে মাদরাসা ও মূলধারার শিক্ষার মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ, পাকিস্তানে অনেক দিকেই এখন উন্নতি হয়েছে, নানা খাতে কাজ এগোচ্ছে।
আর অনেক সাধারণ স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ইলমে দীন অর্জন করছে। একইভাবে মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও আলহামদুলিল্লাহ ঐখানে আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মূলধারায় যুক্ত হচ্ছে। তাই আমার মতে, বাংলাদেশেও এর বড় প্রয়োজন রয়েছে।
আর ভাল হয় যত দ্রুত সম্ভব এখানকার মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরও এই প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কারণ তারা যদি পিছিয়ে পড়ে, তাহলে বাইরের কেউ এসে সেই জায়গা দখল করবে। তাই দ্রুত বিষয়টি উপলব্ধি করে এর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
আর যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করে দরকার হয় তারা চাইলে পাকিস্তানে এসে পড়াশোনা করতে পারে অথবা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পারে। আমরা আল-গাজালি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আমন্ত্রণ জানাই- তারা যেন আসেন। তারা জামিয়া তুর রশিদেও আসতে পারে- সেখানে বিভিন্ন বিশেষ কোর্স ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। এরপর দেশে ফিরে নিজ জাতির সেবা করবে। এতে সমাজের জন্য দারুণ অবদান রাখা সম্ভব হবে।
ইনজামামুল হক : আপনি পাকিস্তানের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান। আমাদের এখানেও ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে অনেক আলোচনা হয়- এটিকে আরও সহজ ও কার্যকর করতে কী করা উচিত?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : দেখুন, শরিয়াহর মূলনীতি মাদরাসার আলেমরা ভালোই জানেন, কিন্তু আধুনিক লেনদেনের বিষয়গুলো অনেক সময় তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাই এসব শেখা তাঁদের জন্য খুব প্রয়োজন। তারা এসব বিষয়ে দক্ষ হয়ে, যখন এই কার্যক্রম পরিচালনা করবে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আস্থা তৈরি হবে।
আমার সুযোগ হয়েছে এখানকার মানুষের সাথে মেশার। আমার মনে হয় এখানকার মানুষ এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়- এখানকার ইসলামী ব্যাংকিং সত্যিই শরিয়াহসম্মত কিনা। এমন তো নয় যে শুধু লেবেলটাই ইসলামিক ব্যাংকিং এর, কিন্তু ভিতরে কাজ সেই পর্যায়ের কাজ হচ্ছে না।
এই আস্থা জনগণের মধ্যে গড়ে তুলবেন শরিয়াহবিদরা। আর শরিয়াহবিদরা তখনই এই কাজ করতে পারবেন, যখন তারা এই ক্ষেত্রের পূর্ণ বুঝ-বোঝ রাখবেন, আর দক্ষতা অর্জন করবেন, এবং গভীর পারদর্শিতা লাভ করবেন।
যখন তারা নিজেরা সরাসরি বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করবেন, তখন তাদের সেই প্রত্যক্ষ দেখা জনগণের জন্য আস্থার উৎস হয়ে উঠবে। তাই এখন দরকার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়া- ভালোভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পারফরম্যান্স অর্জনের চেষ্টা করা। এবং যখন তারা এই যোগ্যতা নিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে সেবা শুরু করবে, তখন প্রতিষ্ঠানগুলোও বুঝতে পারবে এবং জনগণের মধ্যেও আস্থা তৈরি হবে।
ইনজামামুল হক : আপনি জামিয়াতুর রশিদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, এই মাদরাসা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন- ওখানকার শিক্ষার্থীরা কীভাবে পাকিস্তানের জনগণের জন্য কাজ করছেন? আমরা শুনেছি, তারা সরকারি চাকরিতেও রয়েছেন, এমনকি সেনাবাহিনীতেও। এই বিষয়ে আমাদের দর্শকদের জন্য কিছু বলবেন?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জী, আলহামদুলিল্লাহ, জামিয়া তুর রশিদের একটি ব্যাপক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভিশন ছিল। এবং আজ থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ বছর আগেই আমাদের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা এই বিষয়টি অনুমান করেছিলেন- যদি আমাদের সমাজে কাজ করতে হয়, তাহলে সমাজের ধরণ, পদ্ধতি ও বাস্তবতাকে এমনভাবে বুঝতে হবে যাতে আমরা তাদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারি।
তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করলেন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আহ্বান জানালেন যে তারা এসে দীনের জ্ঞান অর্জন করুক। তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে চার বছরের একটি ইসলামী শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করা হলো- কুল্লিয়াতুস শরীয়াহ নামে।
এরপর ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল- অনেক ছেলে আসতে শুরু করল। ভালো মানের শিক্ষার্থী, যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী- এরা সবাই এই চার বছরের প্রোগ্রামে ভর্তি হতে লাগল। পড়াশোনা শেষ করে তারা যখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে ফিরে গেল, কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দিল, কেউ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করল, কেউ নিউক্লিয়ার এনার্জি নিয়ে কাজ করল, কেউ শিক্ষাক্ষেত্রে সেবা দিতে লাগল। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও গেল।
এর ফলস্বরূপ সমাজে এক ইতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে শুরু করল। একইভাবে, মাদরাসার ছাত্রদেরও আধুনিক ও পেশাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হলো। তাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও বাস্তব জ্ঞান প্রদান করা হলো। ফলে তারা এমন যোগ্যতা অর্জন করল যে, তারা বিভিন্ন আর্মীতে সুযোগ পেল। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেবা দিতে পারছে- কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ফাইনান্স বিভাগে কাজ করার সুযোগ পেল, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামিক ব্যাংক, বীমা কোম্পানি- সবখানেই।
এর ফলে যেখানে তারা কাজ করছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উপর আস্থা রাখতে আরম্ভ করল। তারা বুঝেছে, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত যোগ্যতা আছে, যারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারে। তাই আমার ধারণা, যদি এ ধরণের কাজ বাংলাদেশেও শুরু হয়, তাহলে তা অত্যন্ত উপকারী হবে। ছাত্ররা সমাজে গিয়ে সেবা দিতে পারবে এবং আমার বিশ্বাস, এটি হবে একটি জাতি পুনর্গঠনের কাজ।
ইনজামামুল হক : আপনাকে ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। সর্বশেষ, আমাদের দর্শকদের জন্য যদি কিছু বলতে চান?
মুফতি ইহসান ওয়াকার : জ্বি, আমি মিডিয়ার বিষয়ে শুধু এটুকু বলতে চাই- যতটা সম্ভব ইতিবাচক খবর প্রচার করুন, মানুষকে জানান যে, দেশে কত ভালো কাজ হচ্ছে। যাতে মানুষের মধ্যে আস্থা জন্মায় এবং তারা হতাশ না হয়। কারণ সাধারণত যখন নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়।
তাই মিডিয়ার একটি বড় দায়িত্ব হলো- সত্য খবর সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া, যাতে জনগণ আশাবাদী থাকে, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখে এবং মনে করে, হ্যাঁ- দেশে কাজ হচ্ছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই উপকার হবে, ইন শা আল্লাহ।
আইএইচ/এইচআর/এনআর


