-67d6bd042df8b.jpg)
ভূমিকা
একটি সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায়বিচার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ দমন ও প্রতিরোধের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন শাস্তিবিধান কার্যকর হয়েছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ছিল মানবাধিকারবিরোধী, পক্ষপাতমূলক কিংবা দুর্বল আইনি কাঠামোর শিকার। ফলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে গেছে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যা পরকালীন সফলতা ও মুক্তির পাশাপাশি জাগতিক সফলতা ও শান্তিময় সমাজের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রতিটি বিধানই সুন্দর। বর্তমান বেশিরভাগ ব্যাংকগুলো ইসলামের অর্থনীতি সিস্টেম অনুসরণ করে চলছে এবং অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবুও পশ্চিমা এবং ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া ইসলামের সেই সৌন্দর্যকে আড়াল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এর পাশাপাশি জাগতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি সুসংগঠিত শাস্তিবিধান প্রবর্তন করেছে ইসলাম।
এই শাস্তিগুলো প্রতিশোধমূলক নয়; বরং এগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে অপরাধ দমন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর সংশোধন। ইসলামের শাস্তিবিধান অপরাধীকে শুধুমাত্র শাস্তি প্রদানের জন্য নয়; বরং ভবিষ্যতে অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্যও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ইসলামের শাস্তিবিধানের মূল দর্শন
ইসলামের শাস্তিবিধান মূলত পাঁচটি প্রধান লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রণীত হয়েছে:
১. ধর্মের সুরক্ষা– ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করা এবং ধর্মীয় অবমাননা প্রতিরোধ করা। ইচ্ছা হলেই যে কেউ ধর্মীয় কোনো প্রতীক, কোনো নিদর্শন যেন অবমাননা করতে না পারে। এবং ধর্মকে নিয়ে যে কোনো ধরনের তামাশা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে না পারে।
২. জীবনের সুরক্ষা– অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা রোধ করা এবং মানুষের জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা। মানুষের জীবনের সুরক্ষা প্রদানই সাধারণত সবচেয়ে বড় অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। সুতরাং জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে ইসলামী শাস্তি বিধানের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।
৩. বুদ্ধিমত্তার সুরক্ষা– মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে মানুষকে দূরে রাখা, যাতে তারা বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে না ফেলে। বিবেক- বুদ্ধির বিভ্রম ঘটলেই মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৪. সম্পদের সুরক্ষা– চুরি, ডাকাতি ও প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের সম্পদ হরণ প্রতিরোধ করা।
৫. পারিবারিক শৃঙ্খলা ও সমাজের সুরক্ষা– ব্যভিচার, মিথ্যা অপবাদ এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা।
এই পাঁচটি মূলনীতি রক্ষা করাই ইসলামের শাস্তিবিধানের প্রধান লক্ষ্য। সর্বোপরি মানুষের প্রতিটি মানবীয় অধিকার যেন অক্ষুন্ন থাকে, সেজন্য যাবতীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি ইসলাম দিয়েছে একটি কার্যকরী ও পরিপূর্ণ শাস্তি বিধান। এজন্য ইসলামি বিধান বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। কারণ হচ্ছে ইসলামের বিধানের প্রয়োগ ছাড়া একজন মুমিন সমাজে যথাযথভাবে ইসলামি বিধান পালন করতেও সক্ষম হয় না। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন করে না তারা কাফির, তারা জালিম, তারা ফাসিক।’ (সুরা মায়েদা)
ইসলামের শাস্তিবিধানের বিভিন্ন দিক
১. হত্যার শাস্তি (কিসাস ও দিয়া)
ইসলামে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ অন্যকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)
হত্যার শাস্তি হিসেবে কিসাস (প্রতিদানমূলক শাস্তি) নির্ধারিত রয়েছে, অর্থাৎ হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার চাইলে দিয়াহ (রক্তমূল্য) গ্রহণ করে হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারে। এটি ইসলামের ন্যায়বিচার ও মানবিকতার ভারসাম্য বজায় রাখার অন্যতম নিদর্শন।
আমরা চারিদিকে তাকালে দেখতে পাই একের পর এক হতাহতের ঘটনা। একপক্ষ অপরপক্ষকে নিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠছে, কিন্তু আমরা এর কোনো প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ দেখছি না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী হত্যার বদলে হত্যার বিধান বাস্তবায়ন করা হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হতে বাধ্য। কারণ সে কাউকে হত্যা করার আগে আগে একবার ভেবে নেবে, আজকে আমি হত্যা করলে কালকে আমাকেও তো এভাবে হত্যা করা হবে।
(দিয়াহ হলো ইসলামী শাস্ত্রব্যবস্থায় এক ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ, যা হত্যাকাণ্ড বা শারীরিক আঘাতের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়। এটি মূলত নিহত ব্যক্তির পরিবার বা আহত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয়, যাতে প্রতিশোধস্পৃহা প্রশমিত হয় এবং সামাজিক শান্তি বজায় থাকে।)
২. চুরির শাস্তি
চুরি সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি। ইসলামে বলা হয়েছে, ‘চোর, পুরুষ হোক বা নারী, তাদের হাত কেটে দাও—এটাই তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদান।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৮) আমাদের নিম্নবিত্ত থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে কেউ যদি চুরি করে এবং তার ব্যাপারে হাত কেটে দেয় আইন প্রয়োগ করা হয় তাহলে অবশ্যই একটি রাষ্ট্র চোর মুক্ত হয়ে উঠবে। আমরা দেখি, রাষ্ট্রের যে যত বড় পদে চাকরিরত সে তত বড় চোর। কারো চুরি প্রমাণিত হলে যদি এই কোরআনি শাস্তি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সে অবশ্যই নিবৃত হতে বাধ্য।
তবে ইসলামে চুরির শাস্তি দেওয়ার আগে কঠোর যাচাই-বাছাই করা হয়। কতটুকু চুরি করলে হাত কাটা হবে সেটার জন্য সীমারেখা নির্ধারিত আছে। যদি কেউ দারিদ্র্যের কারণে চুরি করে, তবে তার মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করা উচিত।
৩. ব্যভিচারের শাস্তি
পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইসলামে ব্যভিচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবাহিতদের জন্য শাস্তি রজম (পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড), আর অবিবাহিতদের জন্য ১০০ চাবুক। তবে শাস্তি কার্যকর করার জন্য চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়োজন, যা মিথ্যা অভিযোগ প্রতিরোধের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা।
আজকে আমাদের সমাজে ধর্ষক অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকার কোনো আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। একমাত্র ইসলামি বিধানই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেসব রাষ্ট্রে ইসলামী বিধান প্রয়োগ করা আছে সেখানে সাধারণত ধর্ষণের কোনো ঘটনাই ঘটতে দেখা যায় না।
৪. মাদকদ্রব্যের শাস্তি
ইসলামে মাদক ও মদ্যপান হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ এটি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট করে এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ইসলামে মদ্যপানের শাস্তি হাদিস অনুযায়ী ৮০ চাবুক নির্ধারিত হয়েছে।
৫. অপবাদ ও মিথ্যা সাক্ষ্যের শাস্তি
ইসলামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কেউ যদি ব্যভিচারের মতো গুরুতর অভিযোগ তোলে কিন্তু চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে, তবে তাকে ৮০ চাবুক মারার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৪)
৬. ডাকাতির শাস্তি
ডাকাতি সমাজের জন্য একটি মারাত্মক অপরাধ, কারণ এটি মানুষের জান-মালের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। ইসলাম ডাকাতির শাস্তি কঠোরভাবে নির্ধারণ করেছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হলো হত্যা করা, শূলিবিদ্ধ করা, বিপরীত দিকের হাত ও পা কেটে ফেলা অথবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৩)
ডাকাতি যদি হত্যা ও লুটপাটসহ সংঘটিত হয়, তবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদি শুধু লুটপাট হয় তবে হাত ও পা কেটে ফেলার বিধান রয়েছে। আবার, যদি কাউকে শুধু ভয় দেখিয়ে ডাকাতি করা হয়, তবে তাকে নির্বাসিত করা যেতে পারে।
ইসলামের শাস্তিবিধান ও সামাজিক ভারসাম্য
১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা– ইসলাম অপরাধের কারণ দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন- চুরির শাস্তি কঠোর হলেও ইসলামে জাকাত ও সাদাকার মাধ্যমে দরিদ্রদের সহায়তা করা হয়, যাতে কেউ অনাহারে থেকে চুরি করতে বাধ্য না হয়।
২. অপরাধীর সংশোধন ও নৈতিক শিক্ষা– ইসলামের শাস্তির অন্যতম লক্ষ্য অপরাধীর আত্মশুদ্ধি। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি কার্যকর হওয়ার পর অপরাধী সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ পায়।
৩. ন্যায়বিচার ও ক্ষমার সমন্বয়– ইসলামের শাস্তিবিধান প্রতিশোধমূলক নয়’ বরং এতে ন্যায়বিচার ও ক্ষমার সমন্বয় রয়েছে। যেমন, হত্যার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবার চাইলে হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারে।
উপসংহার
ইসলামের শাস্তিবিধান শুধু একটি আইনি কাঠামো নয়; বরং এটি একটি নৈতিক, মানবিক এবং সমাজসংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা। এটি অপরাধ দমন, অপরাধীর সংশোধন এবং সমাজে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস করার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।
বর্তমান বিশ্বে অপরাধ দমনের প্রচলিত আইনগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ইসলামের শাস্তিবিধান কঠোর মনে হলেও, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, অপরাধ দমন ও নৈতিকতার ভারসাম্য রক্ষায় এক অনন্য পদ্ধতি। আধুনিক সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অপরাধের ঊর্ধ্বগতি এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ইসলামি শাস্তিবিধানের প্রাসঙ্গিকতা আরও সুস্পষ্ট করে তুলেছে। যদি ইসলামি আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে, মানুষ নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আশা করি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতেও ইনশাল্লাহ একসময় ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। ইসলামি শাস্তি বিধান কার্যকর হবে। প্রতিটি মানুষ নিজের আপন অধিকার নিয়ে নিশ্চিন্তে নিরাপদে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করবে। ইনশাআল্লাহ।
লেখক: ইমাম, ধর্ম মন্ত্রণালয়, কাতার ও শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা (সাবেক)।
মেইল : yasinabdurrouf@gmail.com
বাংলাদেশের খবরের ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkislamic247@gmail.com
ডিআর/বিএইচ