জাতীয় মসজিদে এ সপ্তাহের মিম্বারের ধ্বনি
আল্লাহর বিধান মানলে দেশে শান্তি আসবে
মুফতি আব্দুল মালেক
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৫
প্রিয় মুসল্লিগণ, মহান আল্লাহ তার মুত্তাকী বান্দাদেরকে কীভাবে পুরস্কৃত করবেন বা একজন মুত্তাকী বান্দার গুণাবলি কি? এককথায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে শরীয়ত আমাদেরকে দান করেছেন, সেই শরীয়ত মেনে চলাই মুত্তাকী। আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা গ্রহণ করা। যা হারাম করেছেন, তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করা এবং ঐ হারাম থেকে বেঁচে থাকা। সুতরাং তাকওয়ার প্রথম সবক হলো ঈমান আনা ও সকল শিরক থেকে বেঁচে থাকা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে ৫টি বিষয়ের নির্দেশ দিয়ে ওহী পাঠিয়েছেন। এগুলো যেন তিনি নিজে আমল করেন এবং বনী ইসরাঈলকেও আমল করতে নির্দেশ দেন। হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম তার উম্মতদের একত্রিত করে আল্লাহর ওহী শোনালেন। এতে প্রথম বিষয় ছিলো, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। সব নবীর একই শিক্ষা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। শিরক থেকে দূরে থাকতে হবে, তাওহীদের উপরে মজবুত থাকতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরয আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাওহীদের উপরে মজবুত থাকা। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর হারাম হলো, শিরিক করা। নবী-রাসুলগণ এটা স্মরণ করিয়ে দিতেন সব সময়। আল্লাহপাক কোরআনের অনেক আয়াতে, শত শতবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই বিশ্বাসের উপরে মজবুত থাকো। শিরক থেকে কি দূরে থাকো। তাহলেই তোমরা সফল হবে।
আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করাটা হলো এমন- এক ব্যক্তি নিজের অর্থে একটা দাস খরিদ করলো। দাসকে একটা ঘরে জায়গা দিলো, এই ঘরে তুমি থাকো। এখান থেকে তুমি কাজ করো, এবং যা উপার্জিত হয় তা আমার কাছে জমা করো। আর সে দাস কাজ করছে ঠিক, কিন্তু যা আয় উপার্জন করল, তা মনিবকে না দিয়ে অন্যকে দিয়ে দিল। তোমাদের কে এটা পছন্দ করবে যে তার দাস এমন হবে? এটা কেউ পছন্দ করবে না।
আমরা একটু চিন্তা করি, সহজে বুঝে আসে যে, আমি আল্লাহর মাখলুক। আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমার হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। রিযিক দিচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। আমার লালন পালন করেছেন তিনি। তাহলে আমি আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে কীভাবে শরিক করি? কাজেই ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে। যে ইবাদতকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে নিবে, অন্যর ইবাদত করবে, অন্যের উপাসনা করবে, সে যুলুম করলো। সব চেয়ে বড় যুলুম হলো এটাই।
আল্লাহ তোমাদের যথাযথ সালাত আদায়ের হুকুম করেছেন। খুশু-খুজুর সাথে। মন ছুটে গেলে আবার ঘুরিয়ে আনতে হবে মনকে। আর চোখ দিয়ে এদিক সেদিক তাকাবেন না।
আল্লাহ রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে ফরয রোজা। রোযার ছোট্ট একটা ফায়দা হলো- মেশকের খুশবু থেকেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে আরও বেশি প্রিয়।
সদকার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। সদকা খায়রাত করো। ফরয সদকা যেটা যাকাত তো বটেই, আরও বেশি সদকা করার চেষ্টা করবে। সদকার অনেক উপকারিতা। একটা উপকারিতা এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, একজন ব্যক্তিকে শত্রুরা বন্দি করে ফেলেছে, এখন তার গর্দান কেটে দিবে। সে বললো, আমি তোমাদেরকে কিছু দিই যা আমার কাছে আছে। এটার বদলে আমাকে ছেড়ে দাও। তারপর সে কিছু দিয়ে মুক্তি পেয়ে গেল।
সদকাটাও এমন। আখেরাতে যখন ধরা পড়বে, জাহান্নামের দিকে টেনে নেওয়া শুরু হবে তোমাকে; তখন এই সদকা, যাকাত, যা তুমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছো, আল্লাহর মাখলুকের সেবায় দিয়েছো, সেগুলো সব হাজির হবে। এগুলোর বরকতে আল্লাহ তাআলা তোমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন। সুবহানাল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে যিকির করতে বলেছেন। বেশি বেশি যিকির করো আল্লাহর। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, দরূদ শরীফ, ইস্তেগফার, কোরআনের তেলাওয়াত, যত ধরনের যিকির আছে। আর সবচেয়ে বড় যিকির হলো পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাজ। নামাজ আদায় করলেই যিকির হয়ে যায়। নামাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যিকির। এটা ফরয।
এছাড়া তাসবিহ, তেলাওয়াত করা, আল্লাহর প্রশংসা, আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা করা, যেভাবে হাদীস শরীফে কোরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা যিকির শিখিয়েছেন, ঐ সমস্ত যিকির করো। এর একটা ফায়দা হলো, কারো পেছনে শত্রু দৌড়াচ্ছে। ওকে ধরে বেঁধে শেষ করবে। হঠাৎ সে একটা দুর্গ দেখে তাতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গেল। এরকম যত ধরনের শত্রু আছে, নফস, শয়তান এবং আরো যত শত্রু; সব শত্রুর শত্রুতা থেকে বাঁচার জন্য দুর্গ হলো যিকির। আল্লাহর যিকিরের দ্বারাই তুমি বালা-মুসিবত থেকে বাঁচতে পারবে। দুনিয়া-আখেরাতে সব জায়গায় মুসিবত থেকে বাঁচতে পারবে।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে আরও ৫টি কাজের নির্দেশ দিচ্ছি, আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন নিজে আমল করার জন্য, তোমাদেরকে বলার জন্য। সেগুলো হল- শ্রবণ, আনুগত্য, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হিজরত, মুসলমানদের মাঝে ঐক্য বজায় রাখা।
৫টি জিনিসের মধ্যে প্রথমটি হলো। শ্রবণ করা বা শোনা এবং আনুগত্য করা। ভালোভাবে খেয়াল করে শোনা, মন লাগিয়ে শোনা। কী জিনিস শুনবো? কোরআন-হাদিস। শরীয়তের মাসালা, শরীয়তের বিধান। ওয়াজ, নসিহত।
শ্রবণ করা, এটা বড় একটা নেক আমল। যে বিষয় শোনার মতো তা যথাযথ শোনা। আর যেটা শোনার মতো না, পাপের কথা, মিথ্যা কথা, গীবত, অপবাদ, ওগুলো শুনবে না।
আরেকটি হলো- আনুগত্য। কার আনুগত্য? আল্লাহর আনুগত্য করো। নবীজির আনুগত্য করো। তোমাদের দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো।
কারা দায়িত্বশীল? দুই শ্রেণীর মানুষ দায়িত্বশীল। এক শ্রেণী হলেন, ওলামা মাশায়েখ। যারা কোরআন হাদিসের নির্দেশনা আমাদেরকে বুঝিয়ে দেন। কোরআন হাদিস অনুযায়ী রাহবারি করেন, তারা হলেন দায়িত্বশীল।
আরেক শ্রেণীর দায়িত্বশীল হলেন, শাসক। ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে তারা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নির্দেশনা মেনে চলা, এটাও আল্লাহর হুকুম। কোনো সমাজ, কোনো রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা ঠিক থাকতে হলে জনগণকে শাসকদের কথা মেনে চলতে হয় বৈধ বিষয়ে, নেক কাজে। এটাও শরীয়তের হুকুম। কিন্তু আল্লাহর নাফরমানি বিষয়ে যদি শাসকরা নির্দেশ দেয়, এই নির্দেশ পালন করা হারাম। অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, এককথায় আল্লাহর নাফরমানির ক্ষেত্রে, হারাম এবং নাজায়েজ কাজের ক্ষেত্রে শাসকের আনুগত্য জায়েজ নাই।
আল্লাহর নাফরমানির ক্ষেত্রে কারো আনুগত্য চলে না। মা-বাবার আনুগত্যও চলবে না, শাসকের আনুগত্যও চলবে না, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা, রাষ্ট্রপতি, যেই নির্দেশ দিক, আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে, কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামী শরীয়তের বিপরীত নির্দেশ যদি দেয়; সেক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান হলো- আল্লাহর নাফরমানি হবে এমন বিষয়ে কারও আনুগত্য করা যাবে না।
আর যদি ওই জুলুমকে, অন্যায়কে, শরীয়তের বিরোধী কথাকে আইন বানিয়ে দেয়, তো এটা তো কত বড় অন্যায়, কত বড় অপরাধ! কত বড় কুফরি কাজ! তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শ্রবণ ও আনুগত্য, শুধু এই দুইটা বিধান শরীয়তের। এই দুইটা বিধানের যাবতীয় তাফসীর যদি আমরা বিশ্লেষণ ও ভালোভাবে বুঝে আমল করতে পারি, তো পুরো দেশে শান্তি এসে যাবে ইনশাআল্লাহ।
শাসক অন্যায় কোনো নির্দেশ করবে না। কোরআন, নবীর সুন্নাহ ও হাদিসের বিপরীত কোনো নির্দেশ করবে না। জুলুম এবং খেয়ানত জাতীয় কোনো নির্দেশনা কাউকে দিবে না। আর যদি এরকম কোনো নির্দেশ কেউ দিয়ে বসে, সেটা জনগণ পালন করবে না। এই দুই নীতির উপরে যদি এসে যাই আমরা, পুরো রাষ্ট্র জান্নাত হয়ে যাবে।
সমস্যা তো এখানে। এক গোষ্ঠী অন্যায় নির্দেশ দেয়, বুঝে না বুঝে। আর নিচের যারা আছে, তারা হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ করে গদি ঠিক রাখার জন্য, চাকুরি ঠিক রাখার জন্য, ভয়ে বা নিজেও অন্যায়ের মধ্যে শরিক; সে কারণে।
সুতরাং, কোরআনের আদেশ ও নিষেধ; এই বিষয়গুলো জানা আমাদের জন্য জরুরি। আজকে সংক্ষেপে শুধু শিরোনামগুলো হলো, আল্লাহ হায়াত রাখলে আগামী সপ্তাহে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। ওয়া আখিরু দা‘ওয়ানা আনিল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল-আলামীন।
অনুলিখন : মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক, সহসম্পাদক, বাংলাদেশের খবর
[গতকাল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমাপূর্ব খুতবা]



