Logo

ইসলাম

যেভাবে ধ্বংস হয় আদ জাতি

Icon

মাওলানা সাইফুল ইসলাম সালেহী

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ২০:৩৫

যেভাবে ধ্বংস হয় আদ জাতি

পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে। নিজেদের যারা মনে করে খুব শক্তিশালী। প্রতিবেশী তাদের অত্যাচারে অসহায়। শক্তির প্রভাব খাটিয়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যের জমি ও ঘরবাড়ি দখল করে থাকে।

বহুদিন আগের কথা। আদ নামক এক ক্ষমতাশালী বাদশাহ ছিল। সে ছিল হজরত নুহ (আ.)  এর বংশধরদের মধ্যে। সেই যুগে ওই আদ বাদশার মতো শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান কেউই ছিল না। তার সন্তান-সন্ততি ও বংশধরগণও ছিল শক্তিমান ও প্রভাবশালী বাদশা আদের নামানুসারে এরা কওমে আদ নামে ইতিহাসে পরিচিতি। এদের মধ্যে কোনো কোনো লোকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশত গজ পর্যন্ত। এদের মধ্যম শ্রেণির লোকদের উচ্চতা ছিল দুইশত গজ পর্যন্ত। আর যারা সবচেয়ে খাটো তাদের উচ্চতা ছিল সত্তর গজ পর্যন্ত। এরা সবাই যেমন ছিল সাহসী, তেমনই ছিল শক্তিশালী। তারা ছিল খুব অহংকারী ও তাদের অন্তর ছিল খুব কঠিন। তারা সত্যকে মিথ্যা বলতে, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করতো। দুর্বল ও নিরীহ মানুষকে খুব অত্যাচার করতো তারা। তাদের বাসভূমি ছিল ইয়ামান দেশের আহ্কাফ নামক জায়গা। মরুচারী ও পাহাড়ি লোক ছিল তারা। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

আল্লাহ ও নবীকে ভুলে গিয়েছিলেন তারা। নিজেদের সাহস ও শক্তির গৌরবে তারা ডুবে গিয়েছিল। সৎকাজ ও ভালোকাজ কখনো করতো না, বরং শয়তানের কুপরামর্শে দেবদেবীর মূর্তির পূজা করতো। কওমে আদের যখন এ অবস্থা প্রবল আকার ধারণ করল, তখন তাদের হেদায়াত করার উদ্দেশ্য কওমে আদের মধ্য হতেই হুদ নামক এক ব্যক্তিকে নবীরূপে প্রেরণ করলেন আল্লাহপাক।

ইরশাদ হয়েছে, আদ জাতির নিকট তাদের ভাই হুদকে নবী রূপে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না? (সুরা আল আরাফ, আয়াত ৬৫)

আদ জাতিদেরকে দেবদেবীর মূর্তি পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদাত করতে বললেন হজরত হুদ (আ.)। কিন্তু নবীর সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করল তারা। কুরআনুল কারিমে এসেছে, তার জাতির নেতারা বলল, আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখছি এবং আমরাতো তোমাকে নিশ্চিত রূপে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে (নবী) বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, বরং আমি হলাম সারা জাহানের রবের মনোনীত রাসুল। (সুরা আল আরাফ, আয়াত: ৬৬,৬৭)

তারপর হজরত হুদ (আ.) শক্তিশালী আদ জাতিকে আল্লাহর সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান করলেন। বললেন, আল্লাহপাকের নিয়ামত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। কুরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পোঁছে দিচ্ছি, আর তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাক্সক্ষী তোমরা কি এতে বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদের জাতিরই একটি মাধ্যমে তোমাদের  রবের পক্ষ হতে তার বিধান ও উপদেশসহ তোমাদের কাছে এসেছে? তোমরা সেই অবস্থার কথা স্মরণ করো যখন নুহের সম্প্রদায়ের পর আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অন্যদের অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে। (সুরা আল আরাফ, আয়াত: ৬৮,৬৯)  

তাদেরকে অনেক বুঝালেন হজরত হুদ (আ.) ও উপদেশ দিলেন অনেক। কিন্তু তারা শুনল না। দীর্ঘদিন ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন হজরত হুদ (আ.), কিন্তু সফল হলেন না। মাত্র ৭০ জনকে কোনরূপে হেদায়াত করতে সক্ষম হলেন তিনি। তারাও কাফেরদের ভয়ে গোপনে আল্লাহর ইবাদাত করত, প্রকাশ্যে ইবাদাত করতে সাহস পেত না। তারপরেও হজরত হুদ (আ.) আদ জাতিদেরকে ধর্মের পথে আহ্বান করছিলেন।

আর আদ জাতি এভাবে তার উত্তর দিচ্ছিল, হুদ! তুমি কি আমাদের কাছে এ আশা করছ যে, আমরা তোমার কথামতো বাপ-দাদার ধর্ম দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে এক খোদার উপাসনা করব? তা তুমি জেনে রাখো, আমরা তোমার খোদার এবাদাত করব না। তুমি যে তোমার খোদার ভয় দেখাচ্ছ যদি সত্যি হয়, তবে তা আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করাও না কেন? না হলে আমরা তো তা বিশ্বাস করবই না; বরং আমরা জানে মেরে ফেলব তোমাকে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট শুধু এই উদ্দেশে এসেছ যে, আমরা যেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের পূজা করত তাদেরকে বর্জন করি? তুমি তোমার কথা ও দাবিতে সত্যবাদী হলে আমাদের যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন করো। (সুরা আল আরাফ, আয়াত: ৭১)

হজরত হুদ (আ.) একেবারে নিরাশ হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘হে মাবুদ! এরা আমার কথা শুনছে না। বরং আমাকে প্রাণে মারার ভয় দেখাচ্ছে। আমার এমন শক্তিও নেই যে, আমি তাদের সাথে পেরে উঠব। তারা অনেক শক্তিশালী। আপনি আমাকে তাদের হাত হতে রক্ষা করুন। বাদশাহ এমন বেশি শক্তির অধিকারী ছিল যে, সে যখন কোনো পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যেত তার জানু পর্যন্ত ঐ পাথরের মধ্যে ডুবে যেত। শক্তির গর্বে আদ কওমের লোকেরা এরূপ বলত যে, কে আছে সারা জাহানের বুকে আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? 

৭০ জন মুমিন উম্মত নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আরো একবার কাফেরদের সত্যধর্মের প্রতি আহ্বান করে হজরত হুদ (আ.) বললেন, তোমরা আমার কথা মেনে নাও এখনও। নতুবা কিন্তু অচিরেই তোমরা আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আদ জাতি হজরত হুদ (আ.) এর কথা শুনে তাকে ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করল। যার ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের দেশে একাধারে তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখলেন। দেশে কোনো ফসলাদি জন্মিল না। ফলে সারাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। গজব শুরু হওয়ার আগে হজরত হুদ (আ.) তার উম্মতগণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করলেন।

আল্লাহ বলেন, অতঃপর তাকে (হুদকে) এবং তার সঙ্গী সাথীদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, আর যারা আমার নির্দের্শকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং যারা ঈমাদার ছিল না তাদের মূলোৎপাটন করলাম। (সুরা আল আরাফ, আয়াত: ৭২)

কিছুক্ষণ পর শুরু হলো ভয়াবহ গজব। মূহূর্তেই প্রবল বেগে তুফান শুরু হলো। দাম্ভিক আদ কওমের লোকদের সকল দাত মুহূর্তে ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল। তাদের ঘরবাড়ি প্রথম ঝাপটায়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। দ্বিতীয়বারে তাদের আশ্রয় জায়গা পাহাড়ের গুহাসমূহে বায়ু প্রবেশ করে তাদের সকলকে বাইরে উড়িয়ে এনে এমনভাবে আছাড় মারল যে, সাত লক্ষ মানুষের দেহগুলো যেন উৎপাটিত খেজুর গাছের মতো নিষ্প্রাণদেহে ভূমিতলে পড়ে রইল। তারপর প্রবল বায়ুর তাণ্ডব ধুলামাটি উড়িয়ে উক্ত লাশগুলোর উপরে এমনভাবে নিয়ে আসল যে, তাতে তারা চাপা পড়ে রইল। আল্লাহ বলেন, আর আদ সম্প্রদায় তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝবায়ু দ্বারা। (সুরা আল হাক্কাহ, আয়াত: ৬) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, তুমি কি দেখনি তোমার রব কি করেছেন আদ বংশের। (সুরা আল ফাজর, আয়াত: ৬)

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক, গবেষক

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর