Logo

ইসলাম

দাম্পত্য জীবনে গোপনীয়তা

Icon

মুফতি উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫

দাম্পত্য জীবনে গোপনীয়তা

দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি কেবল দুজন মানুষের মিলন নয়; বরং দুইটি হৃদয়ের বন্ধন, দুই আত্মার মেলবন্ধন এবং এক নতুন পরিবারের সূচনা। এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব, মাধুর্য ও শান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা ও গোপনীয়তার উপর। গোপনীয়তা দাম্পত্য জীবনের এমন এক অনিবার্য উপাদান, যা এই সম্পর্ককে নিরাপদ রাখে, মর্যাদা দেয় এবং কলহ থেকে দূরে রাখে। 

গোপনীয়তা বলতে বোঝায়, সংসারের অভ্যন্তরীণ বিষয়, স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক আচরণ, মতবিরোধ কিংবা শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কের এমন কিছু দিক যা কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। ইসলাম, নৈতিকতা, সমাজবিজ্ঞান; সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই এই গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, গোপনীয়তা হলো বিশ্বাসের ভিত্তি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূলভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা। যদি এক পক্ষ অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় বাইরে প্রকাশ করে ফেলে, তবে সেই আস্থা ভেঙে যায়। দাম্পত্য জীবনে অনেক সময়ই এমন কিছু ঘটনা বা কথাবার্তা থাকে, যা হয়তো ক্ষণিকের রাগে বা দুঃখে উচ্চারিত হয়, কিন্তু সেগুলো বাইরে প্রকাশ করলে তা সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বাস ও অসম্মানের জন্ম দেয়। ফলে দাম্পত্য জীবন হয়ে পড়ে নড়বড়ে।

দ্বিতীয়ত, ইসলাম দাম্পত্য গোপনীয়তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থায় থাকবে সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তারপর তার গোপন বিষয় প্রকাশ করে।' [সহিহ মুসলিম]

এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হয়, স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখা ধর্মীয় দায়িত্ব। যে এই গোপনীয়তা ভঙ্গ কারে, সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য হবে। এর কারণ, দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, তা পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। সেই সম্পর্কের গোপন দিক প্রকাশ করা মানে নিজের সম্মান ক্ষুন্ন করা এবং অপরের মর্যাদাকে হেয় করা।

তৃতীয়ত, গোপনীয়তা পারিবারিক শান্তি বজায় রাখে। সংসারে ছোটখাটো মতভেদ, ঝগড়া বা মান-অভিমান হতেই পারে। কিন্তু যদি এগুলো আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের সামনে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়। 

বাইরের মানুষ বিষয়টি বুঝতে না পেরে নানা ব্যাখ্যা বা মন্তব্য দিতে পারে, যা সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলতে পারে। অথচ যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে পরস্পরকে বুঝে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন, তাহলে বিষয়টি শান্তভাবে মিটে যায়।

চতুর্থত, দাম্পত্য জীবনের গোপনীয়তা রক্ষা করা মানে সম্মান রক্ষা করা। সংসারের প্রতিটি বিষয় সবার জানার বিষয় নয়। স্বামী বা স্ত্রী যদি একে অপরের ত্রুটি বা দুর্বলতা অন্যদের সামনে প্রকাশ করেন, তাহলে তাদের প্রতি সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। ফলাফল- সম্মানহানি, দূরত্ব এবং পারস্পরিক ঘৃণা। অথচ একজন সত্যিকারের জীবনসঙ্গী কখনও তার প্রিয়জনের ত্রুটি অন্যের সামনে প্রকাশ করেন না; বরং তা ঢেকে দেন ভালোবাসা ও সহানুভূতির আবরণে।

পঞ্চমত, গোপনীয়তা রক্ষা করা মানে সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। যখন সন্তানরা দেখে যে তাদের মা-বাবা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, গোপনীয়তা বজায় রাখছেন, তখন তারা পারিবারিক মূল্যবোধে শিক্ষিত হয়। কিন্তু যদি সন্তানরা ঘরে প্রতিনিয়ত ঝগড়া, অপমান বা গোপন বিষয় ফাঁস হতে দেখে, তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং তারা পরিবার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।

ষষ্ঠত, আধুনিক যুগে গোপনীয়তার সংকট বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ নিজের ব্যক্তিগত জীবন প্রকাশে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অনেকেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ছবি, কথা বা ঘটনার অংশ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে শেয়ার করেন। অথচ এই আচরণ অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। ব্যক্তিগত মুহূর্ত জনসমক্ষে আনলে তা মানুষিক গোপনীয়তার পরিপন্থী এবং ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হতে পারে।

সপ্তমত, গোপনীয়তা রক্ষা করা মানে আত্মসংযম শেখা। রাগ, অভিমান বা কষ্টের সময় অনেকেই না ভেবে কথা বলে ফেলেন, যা পরে অনুতাপের কারণ হয়। দাম্পত্য জীবনে গোপনীয়তা মানে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার বদলে ধৈর্য ধারণ করা। এটা শুধু সম্পর্ক নয়, একজন মানুষের চরিত্রকেও উন্নত করে।

অষ্টমত, গোপনীয়তা রক্ষা করলে দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। যখন স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে এবং একে অপরের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ না করে, তখন তাদের মধ্যে মানসিক নিরাপত্তা তৈরি হয়। এই নিরাপত্তাবোধ ভালোবাসাকে দৃঢ় করে, সম্পর্ককে করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী।

নবমত, গোপনীয়তার অভাব দাম্পত্যে অবিশ্বাস জন্ম দেয়। যদি এক পক্ষ অন্যের কথা বাইরে বলে দেয় বা তৃতীয় পক্ষের পরামর্শে সংসার চালাতে চায়, তবে সন্দেহ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সন্দেহ সম্পর্কের বিষ। তাই দাম্পত্যের প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকা জরুরি, কী বলা হবে, কাকে বলা হবে, কোথায় বলা হবে, তা ভেবে নেয়া উচিত।

সবশেষে বলা যায় দাম্পত্য জীবনে গোপনীয়তা রক্ষা করা কেবল একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়; বরং এটি সুখী, স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ সংসার গঠনের অপরিহার্য শর্ত। স্বামী-স্ত্রীর পারম্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তখনই টিকে থাকে, যখন তারা একে অপরের গোপন বিষয়কে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে দেখেন। যে দম্পতি গোপনীয়তার মূল্য বোঝেন, তারা শুধু সংসার নয়, সমাজকেও শেখান- সম্পর্ক মানে বিশ্বাস, সম্মান ও মর্যাদার সমন্বয়। দাম্পত্য জীবনের গোপনীয়তা সেই পবিত্রতারই প্রতীক, যা একে করে তোলে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও শান্তিময় অধ্যায়।

লেখক: মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর