'মৌলবাদ' শব্দটি আজ কেবল ভাষার অলঙ্কার নয়: এটি একধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার। একসময় এর অর্থ ছিল ধর্মের মূল শিকড়ে ফিরে যাওয়া, আদি রূপে বিশ্বাসকে ধারণ করা। কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দটির ব্যাখ্যা বদলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত, ইসরাইল এমনকি ইউরোপের বহু দেশ এই শব্দটি ব্যবহার করছে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করার জন্য। গণমাধ্যম, রাজনীতি ও একাডেমিক আলোচনাড়সব জায়গায় 'মৌলবাদ' মানেই যেন উগ্রতা, সহিংসতা বা সন্ত্রাস। অথচ বাস্তবে মৌলবাদ মানে ছিল ধর্মের মৌলিক নীতিতে বিশ্বাস।
এই শব্দের বিকৃত ব্যবহার কেবল মুসলমানদের হেয় করতেই নয়, বরং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন ও স্বাধীনচেতা রাজনীতিকে দমন করারও উপায় হয়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে কীভাবে মৌলবাদ শব্দটি পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত ও ইসরাইলের কূটনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং এর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব কী।
মৌলবাদ শব্দের উৎপত্তি ও প্রকৃত অর্থ:
"মৌলবাদ" শব্দের শেকড় পাওয়া যায় ইংরেজি শব্দ Fundamentalism-এ, যা প্রথম ব্যবহৃত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের মধ্যে। তারা বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যা মেনে চলার ওপর জোর দিত এবং আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু আবিষ্কার (যেমন ডারউইনের বিবর্তনবাদ) প্রত্যাখ্যান করেছিল। তখন মৌলবাদ বলতে বোঝাত 'আদি ধর্মীয় বিশ্বাস আঁকড়ে ধরা।'
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর অর্থ পরিবর্তন হতে থাকে। যখন মুসলিম বিশ্বের প্রসঙ্গ আসে, তখন মৌলবাদকে আক্ষরিক অর্থে কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ বলা হলেও ধীরে ধীরে সেটিকে সহিংসতা ও উগ্রতার প্রতিশব্দ
বানিয়ে ফেলা হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রচারণায় এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ইসলামিক মৌলবাদ মানেই সন্ত্রাস। অথচ ইসলামে মৌল অর্থে ফিরে যাওয়া মানে ন্যায়, সাম্য, মানবিকতা ও আল্লাহভীতির প্রতি দৃঢ় থাকা। তাই মৌলবাদ শব্দটির বিকৃত ব্যবহারই আজকের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
ইসলামফোবিয়া ও মৌলবাদ-পশ্চিমা প্রোপাগান্ডার সূচনা:
৯/১১ এর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামফোবিয়া প্রকট হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো মুসলিমদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করে। মুসলিম অভিবাসী সম্প্রদায় হিজাব, দাড়ি কিংবা মসজিদের জন্য বারবার নিগৃহীত হতে থাকে। এই ভয় ছড়াতে পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা বারবার 'ইসলামিক মৌলবাদ' শব্দটি ব্যবহার করেছে।
যে কোনো মুসলিম প্রতিরোধকেই মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আফগানিস্তানের তালেবান, ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ সবাই একই ছাঁচে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টান উগ্রবাদী গোষ্ঠী বা ইউরোপের সাদা জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে কখনো 'Fundamentalist' শব্দটি ব্যবহার হয়নি। এই দ্বিচারিতা প্রমাণ করে মৌলবাদ শব্দটি মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একটি সচেতন প্রোপাগান্ডা। এর মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব দেখাতে চায়, মুসলিমরা জন্মগতভাবে উগ্র, আর তাই তাদের সামরিক নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মৌলবাদের রাজনৈতিক ব্যবহার:
যুক্তরাষ্ট্রের 'ওয়ার অন টেরর' (সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ) আসলে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও ভৌগোলিক স্বার্থ নিশ্চিত করার যুদ্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষের সামনে সেটিকে বৈধতা দিতে বলা হলো- 'আমরা ইসলামিক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছি।' আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া- সব জায়গায় মার্কিন আগ্রাসনকে এই যুক্তি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মার্কিন জনগণ ভেবেছে, তারা ন্যায্য যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।
ইউরোপেও একই প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে। ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধকরণ, ডেনমার্কে কোরআন অবমাননার ঘটনা, ব্রিটেনে মুসলিমদের ওপর বাড়তি নজরদারি- সবকিছুতে 'মৌলবাদ' শব্দের আড়ালে মুসলিমবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশ মুসলিম অভিবাসীদের সামাজিকভাবে কোণঠাসা করতে এই ধারণাটিই ব্যবহার করেছে।
ইসরাইলের স্বার্থে মৌলবাদ আখ্যার প্রয়োগ:
ইসরাইলের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও স্পষ্ট। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে ইসরাইল বরাবরই 'ইসলামিক মৌলবাদী সন্ত্রাসী' বলে আখ্যায়িত করে আসছে। হামাসকে মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যেন তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো সামরিক হামলা বৈধ হয়ে যায়। অথচ বাস্তবে হামাস বা অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠী তাদের মাতৃভূমি ও জনগণকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু ইসরাইল ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো মৌলবাদ শব্দ ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বল করার চেষ্টা করে। এভাবে 'মৌলবাদ' শব্দটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরাইলি দমননীতির অন্যতম হাতিয়ার। তারা জানে, পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিতে একবার যদি কোনো আন্দোলনকে মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তবে বিশ্বের অনেক মানুষই তার প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মৌলবাদ প্রচার:
ভারতে মৌলবাদ শব্দের ব্যবহার দ্বিমুখী। একদিকে দেশীয় রাজনীতিতে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিমদের ওপর দমননীতি চালানোর জন্য ইসলামিক মৌলবাদের ভয় দেখায়। কাশ্মীরের স্বাধীনতার আন্দোলন হোক, কিংবা আসামে নাগরিকত্ব প্রশ্নে মুসলিম নিপীড়ন- সবখানেই 'ইসলামিক মৌলবাদ' শব্দকে ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত প্রচার করে যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মৌলবাদী মুসলমানদের কারণে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এর ফলে বিশ্বমঞ্চে মুসলিম প্রতিবেশীদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এবং ভারত নিজেকে 'সেক্যুলার' ও "উন্নত" দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভারতে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদ দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে- মসজিদ ভাঙা, দাঙ্গা, মুসলিমবিরোধী আইন- সবই তার প্রমাণ। তবুও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুব কমই তাকে মৌলবাদ বলা হয়।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদের কৃত্রিম আলোচনার প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশে মৌলবাদ নিয়ে আলোচনা প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বা আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করেড়বাংলাদেশ মৌলবাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। বাস্তবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় এবং সহিংসতাবিরোধী। কিন্তু এই ধরনের প্রচারণা চালিয়ে দেশকে আন্তজাতিক অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও একই প্রবণতা দেখা যায়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিয়ানমারে মুসলিম পরিচয়কে মৌলবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহজে ধরে নেয়, দক্ষিণ এশিয়া মানেই মৌলবাদ ও উগ্রপন্থা। অথচ সত্য হলো, এ অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানরা কেবল নিজেদের ধর্মীয় আচার মেনে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে চান।
ইসলাম ও মৌলবাদের পার্থক্য:
সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি হলো ইসলামকে মৌলবাদের সমার্থক ভাবা। ইসলাম মানে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবতার শিক্ষা। ইসলামে জবরদস্তি করে কাউকে ধর্মান্তরিত করার সুযোগ নেই, বরং সহাবস্থান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মৌলবাদ বলতে বোঝায় মূল বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরাড়া যে কোনো ধর্মেই থাকতে পারে। খ্রিস্টধর্মে যেমন আছে, হিন্দুধর্মে যেমন আছে, তেমনি ইসলামেও আছে।
কিন্তু পশ্চিমারা ইচ্ছাকৃতভাবে মৌলবাদকে শুধুই ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা অন্যায়ভাবে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখানে ইসলামফোবিয়া ও মৌলবাদের বিকৃত ব্যবহার একে অপরের সঙ্গে মিলে গিয়ে মুসলিম বিশ্বের ওপর অবিচারকে বৈধ করেছে।
পরিশেষে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, "মৌলবাদ" শব্দটি আসলে নিরপেক্ষ ও ধর্মতাত্ত্বিক একটি শব্দ, যার মানে মূলনীতির প্রতি দৃঢ় থাকা। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত ও ইসরাইলের রাজনৈতিক প্রচারণায় এই শব্দটি ভয় ও ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তারা জানে, মৌলবাদ তকমা দিলে কোনো আন্দোলন বা দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া যায়। ফলে মুসলিম বিশ্বের প্রতিরোধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, এমনকি সাধারণ ধর্মীয় জীবনাচরণও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। আজ প্রয়োজন সত্যকে স্বীকার করাড় মৌলবাদ মানে সন্ত্রাস নয়, ইসলাম মানে উগ্রবাদ নয়। বরং যারা এ শব্দকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, তারাই আসলে বিভাজন, ঘৃণা ও দমননীতির রাজনীতি চালাচ্ছে। মুসলিম সমাজকে তাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং বিশ্বকে জানাতে হবেড় ইসলাম শান্তির ধর্ম, আর মৌলবাদকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
লেখক: কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক। বাউশাম, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা

