Logo

ইসলাম

সিরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

Icon

ইমরান নাজির

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৩

সিরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক গল্প-উপন্যাস পড়ি। পড়ি অনেক মনীষীর জীবনীও। পড়া হয় না শুধু আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুতপবিত্র-সুবাসিত জীবনীটা। নজরুলের 'বিষের বাঁশি', রবিঠাকুরের 'অপরিচিতা', বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিড়াল', সৈয়দ মুজতবা আলীর 'প্রবাস বন্ধু' পড়েনি যে এমন মানুষ আমাদের মাঝে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনীটা অধ্যয়ন করেছে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া আমাদের মাঝে খুবই দুষ্কর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উন্নত হিসেবে যেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। বিশ্বকবি হওয়ায় যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি' পড়তে পারি, বিদ্রোহী কবি হওয়ায় যদি নজরুলের 'রাজবন্দীর জবানবন্দী', 'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশি', হুমায়ুন আহমেদেও গল্পসমগ্র, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি পড়তে পারি, তাহলে আমি-আপনি জগতের শ্রেষ্ঠ মহামানবের শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়ে তার সুরভিত জীবনীটা কি পড়তে পারব না? তার পবিত্র সিরাত অধ্যয়নের জন্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারব না? যার জীবনী পড়তে গিয়ে 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশ মনীষীর জীবনী' গ্রন্থের লেখক আমেরিকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ মাইকেল এইচ, হাট (১৯৩২ বর্তমান) বলেছেন, "আমার মতে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই সফল হয়েছিলেন। তার প্রভাব আজও অম্লান।" (Michael H. Hart, 'The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History', New York: Hart Publishing Co., 1978, p. 3) 

উনিশ শতকের খ্যাতনামা ফরাসি কবি ও রাজনীতিবিদ আলফোঁস দে লামারটিন (১৭৯০-১৮৬৯) বলেছেন, "দার্শনিক, বক্তা, নবী, আইনপ্রণেতা, যোদ্ধা, এবং আত্মার পুনর্জাগরণকারী এই সব গুণ এক ব্যক্তির মধ্যে সমবেত হয়েছিল। যদি মহানতা, উদ্দেশ্যের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর সাফল্যকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ধরা হয়, তবে মানব ইতিহাসে মুহাম্মদের সমকক্ষ কেউ নেই।" (Alphonse de Lamartine, Histoire de la Turquie', Paris, 1854, Vol. II, p. 276-277)

বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ও আধুনিক ব্রিটিশ নাটকের অন্যতম জনক জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫-১৯৫০) বলেছেন, "আমি মুহাম্মদের জীবনী পড়েছি। তিনি ছিলেন মানবতার উদ্ধারকর্তা। যদি আজ তার মতো একজন মানুষ পৃথিবীর নেতৃত্ব নিতেন, পৃথিবী শান্তিতে ভরে যেত।" ('The Genuine Islam, Vol. 1, No. 8, 1936)

রোমান ইতিহাসের প্রথম আধুনিক ইতিহাসবিদ ও আঠারো শতকের বিখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-১৭৯৪) তার রচিত প্রধানগ্রন্থ 'The History of the Decline and Fall of the Roman Empire'-এ লিখেছেন, "মুহাম্মদের জীবন শুরু হয়েছিল এক দরিদ্র অনাথ হিসেবে কিন্তু শেষ হয়েছে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতারূপে। তার জীবনীতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার বাস্তব প্রতিফলন।" (Edward Gibbon, 'The History of the Decline and Fall of the Roman Empire', Vol. 5, Chapter 50)

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তথা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, "আমি নবী মুহাম্মদের জীবন অধ্যয়ন করেছি। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সত্য, ধৈর্য ও ন্যায়ের প্রতিচ্ছবি দেখি। তার চরিত্রই ইসলামের শ্রেষ্ঠ প্রচারক।" (Young India, 1924)

বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল-গাজালি রহ. (১০৫৮ ১১১১ খ্রি.) তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ইয়াহইয়াউ উলুমুদ্দীন গ্রন্থে লিখেছেন, "যে ব্যক্তি মুহাম্মদের জীবন অধ্যয়ন করবে, সে বুঝবে আর এরার জীবন ছিল আল্লাহর বাণীর জীবন্ত ব্যাখ্যা।"

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ, (১২৯-১৩৫০ খ্রি.), রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন, আচরণ ও পথনির্দেশের বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে রচিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'যাদুল মা'আদ ফি হাদি খাইরিল ইবাদ' গ্রন্থে লিখেছেন, "নবীজির জীবনী এমন এক বিস্ময়কর অধ্যায় যেখানে আমরা দেখি কেমন করে এক মানুষ আল্লাহর নির্দেশে গোটা বিশ্বকে আলোর পথে নিয়ে গেলেন।"

বিখ্যাত আরবি কবি ইমাম বুসিরি রহ. (১২১১-১২৯৪ খ্রি) রাসূল (সা.)-কে নিয়ে তার রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'কাসিদায়ে বুরদায়' লিখেছেন, "নবীর জীবন সেই আলো, যা অন্ধকারে পথ দেখায়; তার চরিত্র ছিল কুরআনের জীবন্ত রূপ।" (Imam al-Busiri, Oasidat al-BurdahÓ, Verse: 07)

মহাকবি আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) তার কবিতায় লিখেছেন, "আমি নবীর জীবনে দেখেছি সেই চিরন্তন শক্তি, যা দুনিয়ার সব জড়তা ভেঙে মানবতাকে জাগিয়ে তোলে।" যেই নবীজি জীবনভর তার উম্মত তথ্য আমাদের জন্য 'ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি' বলে কেঁদেছেন। যাকে ভালো না বাসলে ঈমানদারের ঈমানে পূর্ণতা আসে না। যার পবিত্র জীবনাদর্শেই রয়েছে মানবজাতির চির শান্তি ও মুক্তি। যার জীবনাদর্শের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কসম করে বলেছেন, "নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।" (সুরা: কলাম, আয়াত নম্বর: ০৪) অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'রাসুলের মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।' (সুরা আহযাব, আয়াত নম্বর: ১১)

তাই, একজন মুমিন হয়ে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উন্নত হয়ে তার জীবনীটা পড়তে না পারলে, তার সম্পর্কে বিশুদ্ধভাবে জানতে না পারলে, তাহলে এর চেয়ে লজ্জা ও দুর্ভাগ্য আমাদের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।

শুনেছি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই মমতাময়ী ছিলেন। ছিলেন ভীষণ দয়ালু। দুঃখীদের সান্ত্বনা, অসহায়দের সাহায্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ, অসুস্থদের শুশ্রুষা, ইত্যাদি ছিল তার সহজাত সুবৈশিষ্ট্যাবলি।

আর ভাবুন তো একবার, কেমন মানুষ হলে পরে একাই একজন ব্যক্তি পুরো বিশ্বকে বদলে দিতে পারেন নিজ আদর্শ দিয়ে। কেমন আদর্শের অধিকারী হলে পরে মুমিনদের জন্য তাকে ভালোবাসা, তার আদর্শ লালন করা ফরজ হয়ে যায়। ভেবে দেখেছেন কি কখনো? না ভাবলে ভাবুন। যার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পাষণ্ড হৃদয়ের মানুষগুলোও সোনার মানুষে পরিণত হয়েছে। যার জীবনী পড়ে অসংখ্য ঈমানহারা মানুষ কালেমা পড়ে ঈমানের সুমিষ্ট সূধা পান করেছে। আশ্রয় নিয়েছে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। যার পবিত্র মুখের কথার দ্বারা কেউ কোনো দিন কষ্ট পায়নি। যার ব্যবহারে কেউ কোনো দিন ব্যথিত হয়নি। যার হস্তযুগল দ্বারা কেউ কোনো দিন আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। পেয়েছেন শুধু মুক্তির দিশা, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথ। আসুন না সেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বচ্ছ নির্মল জীবনীটা আমরা পড়ি।

পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য যদি রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্য-উপন্যাস, গল্প-প্রবন্ধ পড়তে পারি, একটা সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য যদি স্বাধীনতা আর একাত্তর নিয়ে এত পড়াশোনা করতে পারি, তাহলে আমাদের অতীব মূল্যবান জীবন গঠন করার জন্য, কেয়ামতের মাঠে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত পাওয়ার জন্য তার জীবনীটা কি আমরা পড়তে পারব না? একজন মুসলিম এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব (সা.)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ উন্নত হিসেবে তো এটা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার সিরাত অধ্যয়ন করলেই তবে তার সম্পর্কে আমরা জানতে পারব। আর তার সম্পর্কে জানলেই তবে আমাদের জানা হবে তার পবিত্র জীবনপদ্ধতি, পারিবারিক বন্ধন, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতি সম্পর্কে। এবং অজ্ঞতা, বর্বরতা, অত্যাচারে আচ্ছাদিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবের জাহেলি সমাজকে কীভাবে এবং তার কী কী ক্যারিশমেটিক গুণাবলি দ্বারা পরিবর্তন করে তিনি একটি সোনালি সমাজে রূপান্তরিত করেছেন সেই সম্পর্কেও। আরও জানা হবে তার সুশাসনে পরিচালিত হওয়া আরবের প্রথম স্বর্ণালি ইতিহাস সম্পর্কে। তার সুশাসন ও শরিয়াহ আইনে পরিচালিত হওয়া আরবের যেই স্বর্ণালি ইতিহাস আজও অমর হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় এবং বিশ্ববাসীর কাছে। তাই তার সম্পর্কে আমাদের যত বেশি জানা হবে তত বেশি তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমরাঙ্গনের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হতে পারব। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আমাদের ঈমানটা হবে আরও সুদৃঢ়

তাই আমরা প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়ব এবং তার পবিত্র জীবনাদর্শানুযায়ী আমাদের ছোট্ট জীবনটাকে ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তির জন্য গঠন করে তুলব।

লেখক : শিক্ষার্থী, অনার্স তৃতীয় বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর