হাদিয়া বা উপহার এমন এক সুন্দর মানবিক আচরণ, যা কোনো আর্থিক বা বস্তুগত বিনিময় ছাড়াই অন্যের মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। এটি নিছক ভালোবাসা, সম্মান ও সৌজন্যের প্রকাশ। ইসলামি শরিয়তে এই ধরনের দান, অনুদান ও উপহারকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও বরকতময় কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উপহার বা হাদিয়া দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়।
আল-কুরআনের নির্দেশনা : আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে দান, সহযোগিতা ও কল্যাণমূলক কাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'যারা নেক লোক, তারা সেই সব মানুষ; যারা আল্লাহর ভালোবাসার কারণে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আত্মীয়স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাস-মুক্তির কাজে।' (সুরা আল-বাকারা, ১৭৭)
ফিকহের পরিভাষায় 'হাদিয়া' বলতে সেই সম্পদ বা বস্তুকে বোঝায়, যা কাউকে সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়। এটি কোনো বাণিজ্যিক লেনদেন নয়, বরং আন্তরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্যের বহিঃপ্রকাশ। আল্লামা ইবনু রুশদ (রাহি.) বলেন, 'হাদিয়া বলতে সেই জিনিসকে বোঝানো হয়, যা দাতা এমন ব্যক্তিকে দেয়, যাকে সে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা করে এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাকে উপহার প্রদান করে।' (আল-বায়ান ওয়াত তাহসিল (খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা ৩৯৭)
হাদিয়া গ্রহণের শর্ত : শরিয়তে উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপহারটি সৎ এবং ন্যায্য উদ্দেশ্য থেকে প্রেরিত হতে হবে। অর্থাৎ, কোনো উপহার যদি এমন নয়। উদ্দেশ্যে দেওয়া হয় যা অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে, মানবাধিকারে ক্ষতি করে, বা অনৈতিক ও অবৈধ কাজে সহায়তা করে, তাহলে তা গ্রহণ করা অনুমোদনযোগ্য উদাহরণস্বরূপ, উপহার যদি কোনো উচ্চপদ, প্রশাসনিক দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য দেওয়া হয়। যদি এটি অন্যকে প্ররোচিত করে বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্যবহার করা হয়। কিংবা যদি এটি ঘুষ বা অন্য কোনো অবৈধ উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তাহলে উক্ত উপহার গ্রহণ করা হরাম এবং তা বিশ্বাসঘাতকতার একটি রূপ হিসেবে গণ্য হবে।
হযরত আবু সাঈদি (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, নবী কারিম (সা.) এক ব্যক্তিকে সদকা সংগ্রহের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন তিনি বললেন, 'এটি সাদাকার সম্পদ, আর এটি আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।'
এ শুনে নবী (সা.) মিম্বারে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করলেন এবং বললেন, "যে কর্মকর্তাকে আমরা সদকা সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করি, যদি সে এসে বলে যে 'এটি সাদাকার সম্পদ, আর এটি আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে', তার অবস্থা কী হবে? কেন সে শুধু নিজের পিতামাতার ঘরে বসে থেকে দেখলো না যে, তার নিকট কোন উপহার আসে কি না?" তিনি আরও বললেন: 'যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! যা কিছুই সে (অবৈধভাবে) গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন তা কাঁধে বহন করে নিয়ে উপস্থিত হবে। যদি উট হয়, তাহলে তা চিৎকার করবে, যদি গাভী হয় তাহলে তা হাম্বা হাম্বা করবে, অথবা যদি বকরী হয় তাহলে তা ভ্যাঁভ্যাঁ করবে। তারপর তিনি উভয় হাত উঠালেন। এমনকি আমরা তার উভয় বগলের শুভ্র ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেলাম। তারপর বললেন: শোন! আমি কি আল্লাহর কথা পৌঁছে দিয়েছি? এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন।' (সহিহ বুখারি-৭১৭৪)
ইমাম নববি (রহ.) তার মুসলিম শরিফের শারহ-এ বলেছেন যে, এই হাদিসে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দেওয়া হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ করা হারাম এবং এটি বিশ্বাসঘাতকতার অন্তর্ভুক্ত, কারণ এতে সে নিজের দায়িত্ব ও আমানতে খেয়ানত করে।
হারাম উপার্জনকারীর হাদিয়া গ্রহণের হুকুম : যদি কোনো ব্যক্তির সমস্ত উপার্জন বা অধিকাংশ আয় হারাম হয়, তাহলে তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েজ নয়। তবে যদি সে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, 'এই হাদিয়া আমার হালাল উপার্জন থেকে দেওয়া, তাহলে তা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে, যদি কারো উপার্জনের অধিকাংশ অংশ হালাল হয় এবং বাকি অংশ হারাম হয়, তাহলে তার দেয়া হাদিয়া গ্রহণ করা যায়। (কিন্তু এর থেকে বিরত থাকাই উত্তম)। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি, ৫/৩৪২, দারুল উলুম দেওবন্দ, জবাব নাম্বার- ৬০০৪৬১)
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

