জীবন মূলত এক অনন্ত যাত্রা। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত এবং প্রতিটি আচরণ-উচ্চারণ ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হয়ে দাঁড়ায়। এই যাত্রাপথে সম্পদ ও শক্তির ধারাবাহিক প্রবাহ মানবজীবনের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন সেই প্রবাহ সুসমন্বিত ব্যবহার হারিয়ে অরাজকতার দিকে ধাবিত হয়, তখন তা পরিণত হয় এক ভয়াবহ প্লাবনে। এ প্লাবন শুধু অপচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সমাজ ও সভ্যতার অন্তঃস্তলে নীরব গভীর অবক্ষয়ের বীজ রোপণ করে। অপচয়, যা কেবল সামান্য ভুল ব্যবহার নয়, বরং ইসলামের দৃষ্টিতে এক ভয়ানক নৈতিক ব্যাধি। আর এর প্রভাব বহুমাত্রিক। এটি যেমন ব্যক্তির আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করে, তেমনি সমাজের ভেতরে সৃষ্টি করে বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। অপচয় আত্মাকে করে শূন্য, বিবেককে করে অসাড়, আর সমাজকে ঠেলে দেয় এক অমানবিক দিকচক্রবূহ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপচয়ের এ প্রবণতা মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত। প্রথমত: ব্যয়-সংক্রান্ত অপচয়। যেখানে সীমাহীন অর্থ ও সম্পদের অবিবেচক ব্যবহার ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কেই বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয়ত: ভোগ-সংক্রান্ত অপচয়। যেখানে পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের নির্বিচার ব্যবহার কেবল পরিবেশ নয়, গোটা মানবসভ্যতার টিকে থাকার পথকেই বিপর্যস্ত করে তোলে।
ব্যয়-সংক্রান্ত অপচয়ের তিনটি ক্ষেত্র
এক. সৎকাজে অপচয়। ভালো কাজের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত ব্যয় করা। যেমন, সাদকা বা জনহিতকর কাজে মাত্রাতিরিক্ত খরচ করা।
দুই. অসৎকাজে অপচয়। অন্যায় বা পাপ কাজে অর্থ ব্যয় করা। যেমন, অনৈতিক কাজে বা হারাম বস্তুর পেছনে খরচ করা।
তিন. সাধারণ বৈধ কাজে অপচয়। যে সকল কাজে ব্যয় করা বৈধ। তাতেও মাত্রাতিরিক্ত খরচ করা। যেমন, অপ্রয়োজনীয় শপিং বা বিলাসিতার জিনিস-পত্রে অতিরিক্ত ব্যয়।
ভোগ-সংক্রান্ত অপচয় : ভোগ-সংক্রান্ত অপচয় বলতে প্রাকৃতিক সম্পদ, ফসল, পরিবেশগত উপাদান এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহারকে বুঝায়। আল্লাহ তাআলা মানুষের কল্যাণের জন্য মহাবিশ্বের সবকিছুকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।’ (সুরা আল-জাসিয়া-১৩) সুতরাং এই অধীনস্থ সম্পদের ব্যবহার এমনভবে করতে হবে যেন তা ব্যক্তি ও সমাজের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিশ্চিত করে। কোনো ধরনের ক্ষতি বা অকল্যাণের কাজে এই সম্পদ ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
অপচয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্র : ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহ এতই বিস্তৃত যে, প্রায় তা সীমাহীন। আর এটা জীবনের সব দিককেই অন্তর্ভ্ক্তু করে চাই তা ধর্মীয় হোক বা দুনিয়াবি। ফলে এর সঙ্গে শরীয়তের পাঁচটি হুকুমই যুক্ত হয়: ফরজ, মুস্তাহাব, মুবারাহ (অনুমোদিত), হারাম ও মাকরুহ। এখানে আমরা বিশেষভাবে সেই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব, যেখানে আমাদের দৈনন্দিন, মাসিক কিংবা বাৎসরিক ব্যয়ে অপচয় দেখা যায়।
খাদ্য-পানীয় : ইসলামে অপচয় না করার নির্দেশনা
খাদ্য-পানীয় মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য উপাদান। জীবনধারণের জন্য এগুলো যেমন আবশ্যক, তেমনি স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্যও এর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্ম ও দর্শনে এই বাস্তবতা স্বীকার করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু মানব-সৃষ্ট ধর্ম ও মতবাদে খাদ্য ও পানীয়ের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য। যেমন, কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের মধ্যে এমন কঠোরতা দেখা যায়। পাশাপাশি কিছু ধর্মগুরু নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো খাদ্যকে হালাল বা হারাম ঘোষণা করে থাকেন। আবার অধিকাংশ মানুষ কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নিজেদের কামনা-বাসনার দ্বারা চালিত হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে আদম সন্তানগণ! প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা তোমাদের পরিচ্ছদ গ্রহণ করো, আর খাও ও পান করো, তবে অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ: ৩১) ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস (রহ) বলেন, ‘উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, অপচয় না করে পানাহার করা বৈধ।’ এই সকল প্রকার হালাল খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের অনুমতি ততক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ না তাতে অপচয় হয়।
অপচয় বলতে বোঝায় সংযমের সীমা অতিক্রম করা। কখনও এটি হয় হালাল থেকে হারামের সীমায় অতিক্রম করার মাধ্যমে, আবার কখনও এটি হয় ব্যয়ে সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা ইসরা: ২৭)। অতএব, অপচয় যেমন নিন্দনীয়, তেমনি কৃপণতাও নিন্দনীয়। আর প্রকৃত আদর্শ হলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। এজন্যই বলা হয়- ‘আল্লাহর দ্বীন হলো বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির মাঝামাঝি।’ খাদ্য গ্রহণও ইসরাফ (অপচয়) হতে পারে। যেমন, পেট ভরে খাওয়ার পরও অতিরিক্ত খেতে থাকা, ফলে তা শরীরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পানাহারও নিষিদ্ধ।
-691932b6388b5.png)
পানাহারে অপচয়ের প্রকার
এক. হারাম ভক্ষণের মাধ্যমে অপচয়। এটি নিছক সীমা লঙ্ঘন ও পশুত্বপূর্ণ প্রবৃত্তির অনুসরণ, যেখানে না বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ থাকে, না শরীয়তের। যেমন, সুদ খাওয়া, জুয়া খেলা, ঘুষ গ্রহণ, ব্যবসায় প্রতারণা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা ইত্যাদি। সবই মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা, যা নিশ্চিতভাবেই অপচয় ও হারাম। একইভাবে শূকরের মাংস, মৃত জন্তু, হিংস্র পশু-পাখি, মদ্যপান ইত্যাদি ভক্ষণও অপচয় এবং আল্লাহর হকুমের সীমা লঙ্ঘন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, এবং তা হাকিমদের নিকট পেশ করো না এ আশায় যে, তোমরা গুনাহের মাধ্যমে জেনে-শুনে মানুষের সম্পদের কিছু অংশ ভক্ষণ করবে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
দুই. ব্যয় করায় অপচয়। ব্যয়ে অপচয় বলতে বোঝায় প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে অযথা খরচ করা। এটা কখনও হারাম কাজে হয়, কখনও মুবাহ কাজে, আবার কখনও ইবাদতের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক পথ হলো সংযম অবলম্বন করা এবং ব্যয়ে মধ্যপন্থা রক্ষা করা।
পানাহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছুই অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। যা কুরআনুল কারিমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা পানাহার করো, তবে অপচয় করো না।’ (সুরা আরাফ-৩১) ইমাম কুরতুবি (রহ.) (মৃত্যু: ৬৭১ হি.) বলেন, ‘ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেছেন, আল্লাহ এই আয়াতে পানাহার হালাল করেছেন, অপচয় না হওয়ার শর্ত। আর যা প্রয়োজন পরিমাণ হয়, যুক্তি ও শরিয়ত উভয়ের দৃষ্টিতে কাম্য। কারণ, এটি জীবন ও শরীরকে রক্ষা করে।
খাদ্য ও পানীয়ের অপচয়ের বিভিন্ন দিক
পানাহারে অপচয় শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগতভাবেও হতে পারে। নিচে এর প্রধান কিছু প্রকার তুলে ধরা হলো।
পরিমাণগত অপচয়
অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করা। এবং এটিকে অভ্যাসে পরিণত করা। এটি এক ধরনের পশুবৃত্তি, যা ঘৃণ্যতম কর্ম। ইবনে উমার (রাযি.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর সামনে ঢেকুর তুললে তিনি বলেন, ‘তোমার ঢেকুর তুলা বন্ধ করো। কেননা, দুনিয়াতে যে সবচেয়ে বেশি পেট ভরে খায়, কিয়ামতের দিন সে সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।’
গুণগত অপচয়
একই ধরনের খাবার বারবার খাওয়া এবং অন্যান্য খাবার বাদ দেওয়া। যেমন, কেউ যদি শুধু শর্করা, চিনি বা মাংসজাতীয় খাবার খেতে থাকে, তাহলে তা স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে।
হারাম খাবার গ্রহণ
নিষিদ্ধ খাদ্য, যেমন, শূকরের মাংস বা মদ খাওয়া এবং হালাল খাবার বাদ দেওয়া।
প্রতিবেলায় অতিরিক্ত খাবার
প্রতিটি খাবারে মাত্রাতিরিক্ত পদের ব্যবস্থা করা এবং তা কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা। উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) বলেছেন, ‘মানুষের অপচয়ের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার প্রতিটি চাওয়া পূরণ করে।’
আইএইচ/

