Logo

ইসলাম

কুরআন-হাদিসের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

Icon

মুহাম্মদ হেদায়ত উল্লাহ

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬

কুরআন-হাদিসের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

মানবজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো ভাষা। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি সংস্কৃতি, চিন্তা ও আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। আর মাতৃভাষা হলো সেই ভাষা যার মাধ্যমে মানুষ প্রথম পৃথিবী ও স্রষ্টাকে চিনতে শেখে। তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কুরআন ও হাদিস মাতৃভাষার মর্যাদা ও প্রয়োজনীয়তাকে গভীরভাবে নির্দেশ করেছে।

কুরআনের দৃষ্টিতে ভাষার বৈচিত্র্য ও গুরুত্ব : পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-  ‘করুণাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা।’

(সুরা আর-রহমান, আয়াত: ১–৪) এই আয়াতে ভাষা ও বাকশক্তিকে মানবজাতির জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথক করেছে তার চিন্তা ও ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা।

আরেক স্থানে আল্লাহ বলেন-  ‘আর তাহার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্যে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আর-রূম, আয়াত: ২২)

এখানে ভাষার বৈচিত্র্যকে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, জাতি ও ভাষার পার্থক্য বিভেদ নয়; বরং স্রষ্টার সৃষ্টিশৈলীর অপরূপ বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া আল্লাহ আরও বলেন- ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।’

(সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪)

এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে, আল্লাহর বার্তা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে হলে তা তাদের মাতৃভাষায় হতে হবে। কারণ ভাষা যতই মহান হোক, যদি তা শ্রোতার হৃদয়ে না পৌঁছে, তবে বার্তা নিস্ফল হয়ে যায়।

নবী-রাসুলদের দৃষ্টান্ত : নবী-রাসুলগণ তাদের জাতির কাছে নিজস্ব ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। হযরত মুসা (আ.) তার ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে আল্লাহর নিকট তার ভাই হারুন (আ.)-কে সহকারী হিসেবে প্রার্থনা করেছিলেন, কারণ হারুন (আ.) ছিলেন স্পষ্টভাষী ও সাবলীল বক্তা। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-কে প্রেরণ করা হয়েছিল এমন এক সমাজে, যেখানে ভাষার শৈল্পিকতা ও সাহিত্যচর্চা ছিল অসামান্য। আল্লাহ তাআলা তার কাছে নাজিল করেছেন কুরআনের মতো ভাষাশৈলীতে অতুলনীয় এক গ্রন্থ- যা আজও আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে বিরাজমান।

ইসলামি চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা : আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন- ‘স্বজাতির ভাষা বলতে শুধু বুঝতে পারা নয়; বরং যুগের ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে তাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাই উদ্দেশ্য।’ অর্থাৎ, মাতৃভাষার চর্চা কেবল কথাবার্তায় সীমাবদ্ধ নয়; সাহিত্য, জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে সেই ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করাও এক প্রকার ইবাদত।

কবির কণ্ঠে মাতৃভাষার মাহাত্ম্য

কবি ফররুখ আহমদ তার কবিতায় বলেছেন-

‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা

খোদার সেরা দান

বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার

রূপ যে অনির্বাণ।’

এই কবিতার পঙ্ক্তিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়- মাতৃভাষা শুধু যোগাযোগের উপকরণ নয়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত এক সৌন্দর্য ও নেয়ামত।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্ট যে, ভাষা আল্লাহর দান এবং মাতৃভাষা সেই দানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রকাশ। নিজের ভাষাকে ভালোবাসা, চর্চা করা এবং তা দিয়ে সৎ চিন্তা ও সত্য বার্তা প্রচার করা একপ্রকার ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। যে জাতি নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসে, তার চিন্তা ও আত্মপরিচয় কখনো হারায় না। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা মানেই আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

লেখক : প্রভাষক- ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা, পটুয়াখালী, বরিশাল।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর