কথায় আছে, বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু। আমাদের জীবন এবং চারপাশের পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিকভাবে বৃক্ষ রোপণের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনই ইসলামেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ এবং জীবজগতের উপকারে আসে এমন কাজ করতে এবং এমন কাজে উৎসাহ প্রদান করতে কোরআন ও হাদিসে বারংবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমরা জানি যে, বৃক্ষ মানুষের উপকারে আসা উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে যে উপাদানগুলো গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয় তার মধ্যে অক্সিজেন অন্যতম। অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকাটা অকল্পনীয়। আর দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সেই অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে থাকা ছোট-বড় বৃক্ষগুলো। শুধু যে অক্সিজেন সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে, তাও কিন্তু নয়। ফুল, ফল ও প্রশান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করাও বৃক্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানুষের এত এত উপকারে আসা এই বৃক্ষ রোপণে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে বারবার। নিম্নে হাদিসে রাসুল, ফিকহ বিজ্ঞান ও গবেষণার আলোকে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব এবং উপকারিতা তুলে ধরা হলো।
মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের উপকারে আসে এমন বৃক্ষ রোপণকে সদকায়ে জারিয়া বলেছেন। বৃক্ষ রোপণকে সদকাতুল্য আমল গণ্য করে তিনি বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ রোপণ করে বা শস্য বপন করে, তারপর তা থেকে যদি কোনো পাখি, মানুষ বা পশু খায়, তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর: ২৩২০)
এখানে বলা হয়েছে গাছের ফল যদি মানুষের পাশাপাশি পাখি বা পশুও খায় তাতেও রোপণকারী সদকার সাওয়াব পাবে। গাছ রোপণ করার পর যদি তাতে পাখি খাওয়ার মতো সামান্য শস্য বা ফলও ধরে এবং তা পাখি খায় তাহলে রোপণকারী অবশ্যই সাওয়াব পেয়ে যাবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী। বিন্দুমাত্রও সে সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে না। এরপর অন্য একটা হাদিসে বলা হয়েছে, ফসল বা গাছ থেকে উপকার পাওয়াও সদকা। যেমন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম গাছ লাগালে, তা থেকে যতটুকু খাওয়া হয়, চুরি হয় এবং পশু-পাখি খায়, সবই তার জন্য সদকা হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১৫৫৩)
উক্ত হাদিসে খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, গাছের ফল বা ফসল চুরি হয়ে গেলেও রোপণকারীর আমলনামায় সদকার সাওয়াব লেখা হবে। সুবহানাল্লাহ! চুরি হয়ে গেছে বলে তার সাওয়াব কর্তন করা হবে না। অপর হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের উপকারে আসে এমন সব কাজ সদকায়ে জারিয়া। তিনি বলেন, ‘মানুষ মারা গেলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি আমল ব্যতীত। তন্মধ্যে প্রথম যে আমলটি সেটি হলো সদকায়ে জারিয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সদকায়ে জারিয়া কেবল কাউকে টাকা-পয়সা দান করা নয়। এটি হতে পারে, নলকূপ স্থাপন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করণ এবং মানুষ ও পশু-পাখির জন্য বহুল উপকারী বৃক্ষরোপণের মতো প্রশংসনীয় কাজও। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, উপকারী জ্ঞান আর তৃতীয়ত হলো, নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১৬৩১)
আর বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামত শুরু হয়ে গেলেও যদি কারও হাতে একটি বৃক্ষের চারা থাকে এবং সে সেটি রোপণ করার সুযোগ পায়, তবে সে যেন রোপণ করে নেয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর: ১২৯৮১)
আধুনিক বিজ্ঞান এবং গবেষণাগুলোতেও বৃক্ষ রোপণের যথেষ্ট গুরুত্ব এবং উপকারিতা রয়েছে।
এক. পরিবেশের জন্য অক্সিজেন উৎপাদন
বৃক্ষ হলো পৃথিবীর অক্সিজেন কারখানা। প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে প্রায় একশত বিশ কেজি অক্সিজেন উৎপাদন করে, যা দুইজন মানুষের এক বছরের প্রয়োজন মেটাতে পারে।
দুই. কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ
গাছ বছরে গড়ে বাইশ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।
তিন. বায়ু পরিশোধন
বৃক্ষ ধুলো, ধোঁয়া, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে আমাদের চারপাশের পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে।
চার. জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ
বৃক্ষ যে ছায়া প্রদান করে তার ফলে রোদের তাপমাত্রা কমে যায় এবং বাতাসকে আর্দ্র রাখে। পাশাপাশি বৃষ্টিপাতকে সহায়তা এবং জলবায়ুর ভারসাম্যও রক্ষা করে।
পাঁচ. মাটির জন্য যে উপকার বয়ে আনে
গাছের শিকড় মাটিকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। মাটির উর্বরতা বজায় রাখে। আর পাহাড়ি এলাকায় বৃক্ষরোপণ করলে ভূমিধস অনেকাংশে কমে আসে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়াতে সাহায্য করে।
ছয়. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বৃক্ষ
গবেষকরা বলছেন, সবুজ গাছপালা ও প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকলে মানসিক চাপ, রক্তচাপ ও দুশ্চিন্তা কমে যায়। গাছ পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। ফলে গ্রীষ্মকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম হয়। হাসপাতালের রোগীরা সবুজ পরিবেশে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে যা একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে। আরবান ফরেস্ট্রির দেয়া তথ্য মতে, দশ মিটার ব্যাসার্ধে গাছ রোপণ করলে দিনে তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায় এবং এই গাছগুলো বছরে বারোশত মানুষের জীবন রক্ষা করে। (উইকিপিডিয়া)
গাছ কাটার ক্ষতিসমূহ
ভূমিধস ও মাটি ক্ষয়: বৃক্ষের শিকড় মাটি ধরে রাখে। গাছ কাটা হলে মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে, চুনাপাথর ও নদীর পাড়ে মাটি গিয়ে পড়ে এবং মাটির উর্বরতা অনেকাংশে কমে যায়।
প্রাণী বিলুপ্তি ও বাসস্থান বিনষ্ট: আমাদের চারপাশে থাকা গাছগুলোতে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আশ্রয় নিয়ে থাকে। অকারণে গাছ কাটা হলে তাদের বাসস্থান নষ্ট হয় এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্তি বা বিলুপ্তির পথে চলে যায়। (World Wildlife Fund, Deforestation and forest degradation. Threats. (Dec, 04, 2018)
জলচক্র/পানির সরবরাহে প্রভাব: গাছ বায়ুতে জলীয়বাষ্প ছড়িয়ে দেয়, মেঘ তৈরি ও বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করে। গাছ কমলে বা কাটলে বৃষ্টির পরিমাণ ও নদীর পানির প্রবাহ পরিবর্তিত হতে পারে, শুষ্ক মৌসুমে জলসীমা কমে যেতে পারে। (প্রাগুক্ত)
বন্যার সম্ভাবনা: মাটি এবং গাছ বৃষ্টির পানিকে শোষণ করে; গাছ কমে গেলে পানি দ্রুত খাল-বিল বা নদীতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। ফলে বন্যার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। (CIFOR-ICRAF Forests news, Bangladesh Forests disappearing at “Alarming Rate”. (June, 04, 2012)
আবহাওয়ার পরিবর্তন ও গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি: বৃক্ষ কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। এজন্য গাছ কাটা হলে এর শোষণ কমে যায়। ফলে জমে থাকা কার্বন বাহিরে ছড়িয়ে পড়ে। যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ছায়ার অভাব: বৃক্ষ আমাদেরকে ছায়া ও শীতলতা প্রদান করে। বৃক্ষ কর্তনে জায়গার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। শহুরে এবং গ্রামাঞ্চলে গরম বাড়তে থাকে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব: ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং ভূমিধস ইত্যাদির মতো ধ্বংসাত্মক প্রভাবগুলো বেড়ে যায়, যখন কোনো অঞ্চল থেকে বৃক্ষ ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। এর একটা বাস্তব উদাহরণ হল- চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা। অনবরত বনাঞ্চল এবং বৃক্ষ কর্তনের ফলে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূমিধস, মাটি ক্ষয় ও জীবনযাত্রার অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বৃক্ষ হলো মানুষের জীবনধারণ এবং মানুষের চারপাশের পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম একটি মাধ্যম। কাজেই মানুষকে দৈনন্দিনজীবনে নির্মল অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হলে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি প্রকৃতি এবং পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে অপ্রয়োজনে বৃক্ষ কর্তন পরিহার করতে হবে। তবেই আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। আর প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক : শিক্ষার্থী, অনার্স ৩য় বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

