আজ বিশ্ব শিশু দিবস
ইসলামে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:০৬
বিশ্ব শিশু দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- প্রতিটি শিশুই একটি স্বতন্ত্র সত্তা, যার রয়েছে বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা, শিক্ষা, ভালোবাসা ও মর্যাদার অধিকার। আধুনিক বিশ্ব শিশু অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার করেছে মাত্র কয়েক দশক আগে, কিন্তু ইসলাম প্রায় চৌদ্দ শ বছর আগেই শিশুর সম্মান, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে, শিশুর প্রতি দায়িত্ব পালন শুধু সামাজিক কর্তব্য নয়- এটি আল্লাহর নির্দেশ মানার অংশ, এক প্রকার ইবাদত।
শিশু আল্লাহর বিশেষ আমানত
ইসলাম সন্তানকে আল্লাহর দেওয়া একটি নৈসর্গিক উপহার ও পবিত্র আমানত হিসেবে ঘোষণা করেছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- “সম্পদ ও সন্তান দুনিয়ার শোভা।- (সুরা কাহফ-৪৬) এ আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- শিশু শুধু পারিবারিক সুখের উৎস নয়, বরং সমাজের সৌন্দর্য ও ভবিষ্যতের ভিত্তি। তাই তাকে লালন-পালন করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব।
শিশুর প্রতি ভালোবাসা- ঈমানের প্রকাশ
রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুদের প্রতি অগাধ মমতা ও স্নেহ দেখাতেন। তিনি বলেন- “যে ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিজি-১৯৮১) শিশুর প্রতি ভালোবাসা, কোলে নেওয়া, আদর করা- এসব নবীর সুন্নত। এক ব্যক্তি যখন বললেন যে তিনি কখনও সন্তানকে চুমু খান না, তখন নবী (সা. বলেছিলেন- “আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে দয়া তুলে নিয়েছেন, আমি কী করতে পারি?” (বুখারি-৫৯১৮-মুসলিম- ২৩৩৭) এ থেকেই বোঝা যায়, দয়া-মমতা শুধু আবেগ নয়-এটি একজন মুমিনের চরিত্র।
শিশুর জীবনরক্ষায় ইসলামের কঠোর নির্দেশ
জাহেলিয়াত যুগে কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার ভয়ঙ্কর প্রথা ইসলামের আগমনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়। আল্লাহ বলেন-“দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না; তাদের রিজিক আমিই দেই, তোমাদেরও দেই।”(সুরা আল-ইসরা ৩১) এ আয়াত শিশুর জীবনের অমূল্য মর্যাদা ঘোষণা করে- দারিদ্র্য, ভয় বা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তার জীবন হরণ বা অবহেলা কোনোটিই বৈধ নয়।
শিশুর প্রতি ন্যায়বিচার ও সমান আচরণ
ইসলাম সন্তানদের প্রতি সমান আচরণকে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন- “তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ন্যায়বিচার করো।”(বুখারি- ৮৮১; মুসলিম- ১৬৭৭) স্নেহ, উপহার, সুযোগ- সব ক্ষেত্রেই ন্যায় বজায় রাখতে হবে। কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব শিশুর মনোজগতে ক্ষত তৈরি করতে পারে।
শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের গুরুত্ব
ইসলাম শিক্ষাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। শিশুর ঈমান, নৈতিকতা ও সাধারণ শিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়া তার মৌলিক অধিকার। নবী (সা.) বলেন- “তোমরা তোমাদের সন্তানকে সম্মান করো এবং তাদের উত্তম শিক্ষাদান করো।”(ইবন মাজাহ- ২৩২৭) অভিভাবকের দায়িত্ব এখানেই সীমাবদ্ধ নয়- শিশুকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সে সমাজের জন্য উপকারী, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় এবং নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠে।
শিশুর নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মানসিক বিকাশ
ইসলামে শিশু নির্যাতন, অবহেলা বা কঠোর আচরণ নিষিদ্ধ। সাহাবায়ে কেরাম শিশুদের শারীরিক শাস্তির ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন এবং নরম আচরণের পরামর্শ দিতেন। শিশুর প্রতি সহিংসতা বা কঠোরতা কোরআন-সুন্নাহর নীতির পরিপন্থী। শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে হলো- নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্য ও শারীরিক যতœ, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্মত শিক্ষা, খেলাধুলা ও মানসিক বিকাশের সুযোগ, সম্মান ও আত্মমর্যাদা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অধিকার। এসবই আল্লাহর অর্পিত আমানত হিসেবে পালন করতে হবে।
শিশুর জন্য দোয়ার গুরুত্ব
অভিভাবকের দোয়া সন্তানের জন্য বরকত, হিদায়াত ও সাফল্যের দ্বার খুলে দেয়। কোরআনে উল্লিখিত আছে- “হে আমার প্রভু! তাদেরকে নেককার করো।” (সুরা আল-আহকাফ-১৫) দোয়া শুধু সন্তানের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ নয়; এটি তার ভবিষ্যৎ জীবনপথকে আল্লাহর রহমতে শোভিত করার উপায়।
বিশ্ব শিশু দিবসে ইসলামের বার্তা
বিশ্ব শিশু দিবস আধুনিক উদ্যোগ হলেও এর মূল মূল্যবোধ ইসলাম যুগযুগান্তর আগেই প্রতিষ্ঠা করেছে। এ দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়-শিশুরা সমাজের ভবিষ্যৎ। তাদের অধিকার আল্লাহর প্রদত্ত, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ইবাদত। তাদের শিক্ষিত, নৈতিক ও সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা ঈমানের অংশ। আমাদের সমাজে এখনো শিশু শ্রম, বাল্যবিবাহ, নির্যাতন, শিক্ষাবঞ্চনা- এসব সমস্যা রয়েছে। ইসলামের মানবিক আদর্শ বাস্তবায়ন করলে এই সমস্যাগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক : ইসলাম-বিষয়ক প্রবন্ধকার

