Logo

ইসলাম

সামাজিক অপরাধ রোধে করণীয়

Icon

মুফতি উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১০

সামাজিক অপরাধ রোধে করণীয়

সমাজ মানুষের সমষ্টিগত জীবনযাত্রার প্রতিফলন। মানুষ সামাজিক জীব, তাই একা বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই সমাজ যখন নৈতিকতা, সততা ও মানবিকতার পথ থেকে সরে যায়, তখনই সেখানে জন্ম নেয় নানান ধরনের অপরাধ। চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি, খুন, ধর্ষণ, ঘুষ, জুয়া, দুর্নীতি, কিশোর অপরাধ; এসবই সামাজিক অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে এসব অপরাধের মূল কারণ চিহ্নিত করে তা রোধের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

সামাজিক অপরাধের কারণ

সামাজিক অপরাধ কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। এর পেছনে থাকে বহু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক কারণ।

প্রথমত: নৈতিক অবক্ষয়-যখন সমাজের মানুষ আল্লাহভীতি ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যায়, তখন অপরাধের জন্ম হয়। পিতা-মাতা, শিক্ষক ও সমাজ যদি সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা না দেন, তবে তারা সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত: দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। যখন কোনো ব্যক্তি দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকে বা দারিদ্র্যের কষাঘাতে ভোগে, তখন সে কখনো কখনো সহজ পথ খুঁজে নেয়- যা অনেক সময় অপরাধের পথে নিয়ে যায়।

তৃতীয়ত: মাদকের বিস্তার ও অসৎ বন্ধুসঙ্গ। আজকের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ মাদকের শিকার। মাদক মানুষকে মানবিক গুণাবলি থেকে বঞ্চিত করে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে।

চতুর্থত: আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্মার্টফোন এখন অপরাধ বিস্তারের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সাইবার অপরাধ, প্রতারণা, পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পঞ্চমত: আইনের দুর্বলতা ও বিচারহীনতা। অনেক সময় অপরাধীরা শাস্তি থেকে বাঁচে, ফলে অপরাধ বাড়ে। বিচার না হলে মানুষ নির্ভয়ে অন্যায়ের পথে এগিয়ে যায়।

সামাজিক অপরাধের পরিণতি

সামাজিক অপরাধ শুধু একক ব্যক্তি বা ভুক্তভোগীর ক্ষতি করে না; বরং পুরো সমাজের শান্তি নষ্ট করে। এর ফলে সমাজে ভয়, অনাস্থা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যায়, পরিবারে কলহ বৃদ্ধি পায়, আর মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট হয়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন থমকে যায়, সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘিœত হয়।

সামাজিক অপরাধ রোধে করণীয়

১. নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার: অপরাধ দমনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা। পরিবার, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল ও সমাজ-সবার সম্মিলিত উদ্যোগে নৈতিকতার পাঠ ছড়িয়ে দিতে হবে। কুরআন ও হাদিসের শিক্ষায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যেন তারা বুঝতে পারে- অন্যায় ও অপরাধ আল্লাহর কাছে কঠোর শাস্তিযোগ্য।

২. পরিবারে সুশিক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ: পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। সন্তানদের সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব সর্বপ্রথম পিতা-মাতার। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, মোবাইলে কী করছে; এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পরিবারের ভালোবাসা ও নজরদারি সন্তানকে অপরাধের পথ থেকে দূরে রাখে।

৩. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা: শিক্ষা শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়; এটি মানুষকে মানুষ বানায়। তাই বিদ্যালয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শিক্ষকরা যেন কেবল জ্ঞান নয়, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারেন।

৪. বেকারত্ব দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি: বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। সরকার ও সমাজের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র, ক্ষুদ্র ঋণ, স্বনির্ভর কর্মসূচি ও উদ্যোক্তা তৈরির ব্যবস্থা নিতে হবে। যখন যুবকরা কর্মে যুক্ত থাকবে, তারা অপরাধের চিন্তা থেকে দূরে থাকবে।

৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দ্রুত বিচার: অপরাধ দমনে শক্তিশালী আইন ও তার কঠোর প্রয়োগ অপরিহার্য। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে সমাজে অপরাধের ভয়াবহতা কখনো কমবে না।

৬. মাদক নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম: মাদকসেবীদের শুধু শাস্তি নয়, পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তাদের সমাজে ফিরিয়ে আনতে পারলে একদিকে অপরাধ কমবে, অন্যদিকে মানবসম্পদ বৃদ্ধি পাবে।

৭. সচেতন নাগরিক সমাজ গঠন: প্রতিটি নাগরিককে অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবেশী যদি অন্যায় করে, তবে চুপ না থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। সমাজে দায়িত্বশীলতা ও একতা থাকলে অপরাধ টিকতে পারে না।

৮. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার: আজকের তরুণ প্রজন্ম অনলাইনে বেশি সময় কাটায়। তাই ইন্টারনেটে অপরাধপ্রবণতা কমাতে সচেতনতা কর্মসূচি চালানো দরকার। একইসঙ্গে ইতিবাচক, শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক কনটেন্ট তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নৈতিকতা বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৯ সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা: গণমাধ্যম সমাজের আয়না। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে পারে। অপরাধীদের পক্ষ না নিয়ে সমাজে ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে।

১০. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আলেম সমাজের ভূমিকা: মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো সমাজে নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে। আলেম সমাজ যদি জুমার খুতবায় ও ওয়াজ-মাহফিলে অপরাধের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করেন, তবে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।

লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম অপরাধ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর