Logo

ইসলাম

জুমার বয়ান হোক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার

Icon

মুফতি উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩৫

জুমার বয়ান হোক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার

জুমার নামাজ মুসলিম সমাজে এক অনন্য মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়োজন। এটি শুধু একটি ইবাদত নয়; বরং এটি মুসলিম সমাজের চিন্তা, চরিত্র ও আচরণ গঠনের এক মহান সুযোগ। প্রতি শুক্রবার বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মুসলমান একসাথে মসজিদে সমবেত হয়, শুনে আল্লাহর বাণী, নবীজি সা.-এর আদর্শ ও ইসলামি সমাজব্যবস্থার শিক্ষা। এই সাপ্তাহিক সমাবেশ, যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে তা হতে পারে এক অসাধারণ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই জুমার বয়ান কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়। অথচ এর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা, দুর্নীতি অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা এবং ইসলামি সভ্যতার আলো ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

জুমার বয়ানের তাৎপর্য

জুমার দিন আল্লাহ তাআলা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- 'জুমার দিনের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যে মুহূর্তে বান্দা আল্লাহর কাছে যা চাইবে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করবেন।' [বুখারি, মুসলিম)

এ দিন মুসলমানদের একত্র হওয়ার দিন। তাই জুমার বয়ান হচ্ছে ইসলামি সমাজের সাপ্তাহিক পাঠশালা। এখানে ইমাম বা খতিব আল্লাহর নির্দেশ, রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবন, নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ব, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও মানবিক আচরণের শিক্ষা দেন। এই বয়ান যদি বাস্তবধর্মী, প্রাসঙ্গিক ও হৃদয়গ্রাহী হয়, তবে তা সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নবীজি সা. এর যুগে জুমার বয়ানের প্রভাব রাসুলুল্লাহ সা. মদিনার সমাজে জুমার বয়ানকে সমাজ পরিবর্তনের মূলমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মসজিদে নববী ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিচারালয় ও নীতিনির্ধারণের স্থান। নবীজি সা. খুতবার মাধ্যমে মানুষকে তাওহিদ, তাকওয়া, আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা, প্রতিবেশীর অধিকার, নারী-পুরুষের মর্যাদা, শাসকের দায়িত্বসহ সমাজ নির্মাণের মূল নীতিগুলো শেখাতেন। তাঁর জুমার খুতবাগুলো ছিল ছোট, স্পষ্ট ও জীবন্ত বার্তায় ভরপুর। ফলে অল্প সময়ে মুসলমানরা গড়ে তোলে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।

বর্তমান সমাজের চিত্র

আজকের সমাজ নানা অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত। তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল, সামাজিক আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আল্লাহভীতিহীন, নৈতিকতাশূন্য জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অস্থিরতা কাটাতে রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন হৃদয় পরিবর্তনের। আর হৃদয় পরিবর্তনের সবচেয়ে কার্যকর মঞ্চ হতে পারে জুমার বয়ান।

সমাজ বিনির্মাণে জুমার বয়ান

এক, নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়ন: জুমার বয়ান মুসলমানদের ঈমান জাগ্রত করে, তাদের আত্মাকে পবিত্র করে। যখন মানুষ আল্লাহর ভয় ও পরকালচিন্তা অর্জন করে, তখন সে মিথ্যা বলে না, ঘুষ নেয় না, অন্যায় করে না। এভাবে বয়ান সমাজে নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করে।

দুই, সামাজিক ঐক্য ও সংহতি প্রতি জুমায় একই কাতারে ধনী-গরিব, নেতা জনতা, উচু-নিচু সবাই দাঁড়ায়। খুতবার বিষয়বস্তু যদি সামাজিক ঐক্য, পারস্পরিক সহযোগিত্য ও সহনশীলতার বার্তা দেয়, তাহলে সমাজে বিভক্তি নয়, একতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

তিন, অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগরণ: ইসলামি খুতবার অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করা। খতিব যদি আল্লাহভীতিপূর্ণভাবে দুর্নীতি, শোষণ, জালিয়াতি, নারী নির্যাতন ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে মুসলমানদের হৃদয়ে ন্যায়বিচারের চেতনা জেগে ওঠে।

চার, অর্থনৈতিক শিক্ষা ও দান-সদকার অনুপ্রেরণা জুমার বয়ানে যদি জাকাত, সদকা, ইনফাক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের শিক্ষা তুলে ধরা হয়, তবে ধনী সমাজ দায়িত্ববান হবে এবং দরিদ্ররা পাবে সহায়তা। এভাবে জুমার মঞ্চ হতে পারে দারিদ্রা দূরীকরণের এক বাস্তব হাতিয়ার।

পাঁচ, তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালনা: আধুনিক যুগে তরুণরা নানা বিভ্রান্তির মুখে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার, মাদক, নাস্তিক্যবাদ, অশ্লীলতা তাদের গ্রাস করছে। খুতবার বিষয়বস্তু যদি সময়োপযোগী হয়-যেমন 'ইন্টারনেটের নৈতিক ব্যবহার', 'তরুণদের দায়িত্ব', 'পরিবারের প্রতি কর্তব্য'-তবে তা হবে তাদের আত্মত্মশুদ্ধির প্রেরণা।

ছয়, নারীর মর্যাদা ও পারিবারিক স্থিতি রক্ষা: জুমার বয়ানে পরিবার, বিবাহ, নারী-পুরুষের অধিকার, সন্তান লালন-পালনের বিষয়গুলো আলোচনা করলে সমাজে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে।

সাত, জাতীয় ও বৈশ্বিক মানবতা জাগ্রত করা: ইসলাম শুধু মুসলমানের জন্য নয়: বরং মানবতার ধর্ম। খুতবার মাধ্যমে মুসলমানদের মানবিক দায়িত্ব, পরিবেশ রক্ষা, প্রতিবেশীর অধিকার ও বৈশ্বিক ন্যায়ের প্রতি উৎসাহিত করা সম্ভব।

জুমার বয়ান কেমন হওয়া উচিত

এক, খুতবার বিষয়বস্তু হোক সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক। যেমন- 'পরিবারে ভালোবাসার ভূমিকা', 'সত্যবাদিতার শক্তি', 'পরিবেশ রক্ষায় মুসলমানের দায়িত্ব', 'ইসলামে কর্মসংস্কৃতি', 'ইসলামি অর্থনীতি বনাম সুদব্যবস্থা' ইত্যাদি।

দুই, খতিব হোন জ্ঞানী, পরহেজগার ও সমাজসচেতন। তাঁর কথায় যেন আল্লাহভীতি ও আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। কেবল মুখস্থ বয়ান নয়; বরং তিনি যেন বাস্তব উদাহরণ, কুরআন-হাদিসের প্রমাণ ও জীবনের প্রয়োগ তুলে ধরেন।

তিন, বয়ান হোক সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর প্রভাবশালী। নবীজি সা. বলেছেন, 'সংক্ষিপ্ত খুতবা এবং দীর্ঘ নামাজই জ্ঞানীর লক্ষণ।' [মুসলিম| তাই দীর্ঘ বক্তৃতা নয়; বরং অর্থবহ সংক্ষিপ্ত বার্তা বেশি কার্যকর।

চার, ভাষা হোক সহজ ও প্রাণবন্ত। গ্রামের মানুষ যেমন বুঝতে পারে, শহরের শিক্ষিত শ্রেণিও যেন উপকৃত হয়।

পাঁচ, খুতবায় দাওয়াত ও সতর্কতা-দুই-ই থাকা উচিত। শুধু ভয় দেখিয়ে নয়; বরং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়ে মানুষকে বদলাতে হয়।

ইসলামের ইতিহাসে জুমার বয়ানের সামাজিক প্রভাব

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, বহু সংস্কার আন্দোলন জুমার খুতবার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। হজরত উমর রা. তাঁর খুতবায় মানুষকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেন। হজরত আলী রা. সমাজে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার বার্তা প্রচার করতেন। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ রহ, তাঁর জুমার বয়ানে মানুষের হৃদয় এতটাই প্রভাবিত করতেন যে, তার শাসনামলে একজনও গরিব পাওয়া যেত না। এ থেকেই বোঝা যায়, জুমার মঞ্চ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জুমার বয়ানের গুরুত্ব

বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ মসজিদ আছে। যদি প্রতিটি মসজিদে প্রতি শুক্রবার মানুষকে সচেতন করার মতো, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্বের বয়ান দেওয়া হয়, তবে কয়েক মাসের মধ্যেই দেশজুড়ে এক নৈতিক জাগরণ দেখা দেবে। মানুষ ঘুষ ও অন্যায় থেকে দূরে থাকবে। পরিবারে শান্তি ও পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। তরুণরা ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে। সমাজে অপরাধ কমে যাবে। অতএব, জুমার মিম্বরকে কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়। বরং সমাজ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

এক, অনুপযুক্ত খতিবের নিয়োগ: অনেক স্থানে খতিবগণ আধুনিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞ। তাই ইমামদের প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন।

দুই, রাজনীতি বা দলীয় বক্তৃতা পরিহার করা: খুতবা হবে ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা কেন্দ্রিক। দলীয় বা বিভেদমূলক বক্তব্য জুমার পবিত্রতাকে নষ্ট করে।

তিন, খুতবা প্রস্তুতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। নিজ উদ্যোগে অথবা স্থানীয় উলামা সম্মিলিতভাবে সময়োপযোগী খুতবার বিষয় নির্ধারণ করতে পারে।

চার, তরুণদের জন্য বিশেষ বার্তা: সমাজ গঠনের মূল শক্তি তরুণ সমাজ। তাই খুতবার অংশে তাদের জন্য আলাদা অনুপ্রেরণা থাকা উচিত।

পাঁচ, মিডিয়ায় জুমার বয়ানের প্রচার: ভালো খুতবা টেলিভিশন, ইউটিউব, রেডিও ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করলে তার প্রভাব বহুগুণে বাড়বে।

সমাজের আলোকবর্তিকা

জুমার বয়ান শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতির অংশ নয়; এটি হলো সমাজ পরিবর্তনের এক বিশাল প্ল্যাটফর্ম। নবীজির যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই বয়ানই মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের সবচেয়ে সফল মাধ্যম। যদি প্রতিটি খুতবা হয় আল্লাহভীতি, মানবতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সংস্কারের বার্তাবাহী; তবে আমাদের সমাজে অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের জায়গা থাকবে না। জুমার মিম্বর হোক জ্ঞান, নৈতিকতা, ঐক্য ও মানবিকতার কেন্দ্র। খতিব হোক সমাজের আলোকবর্তিকা। তাহলেই মুসলিম সমাজ হবে ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণের দৃষ্টান্ত।

লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর